"তোরা চা খাস না সকালে?" শ্রীমতি ভয়ঙ্করীর সেই বিখ্যাত ডায়লগ মনে পড়ে গেল। ডলি রায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই পনের শতাংশ সিনেমা। পাঁচ শতাংশ রাজনীতি আর আশি শতাংশ চা মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। এযাবত দেড়শরও বেশি বার কফি খেতে কাচের দরজা ঠেলেছি। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের জীবনে ছ-সাতশ বার চালু চা খেয়ে ফেলেছি। রিপোর্টারি করতে গেলে চা ছাড়া চলে! দুধ চা, লিকার চা, লেবু চা, আদা চা, কালো চা, ঠান্ডা চা, তেতো চা, শান্ত চা, কড়া চা, সরবত চা, এক ফুট চা, দু ফুট, এক গজ চা... সারাদিন চা খেতে খেতে পেটে চরা পরে গেল। কিন্তু ডলি রায়ের দোকানে যাওয়ার পর থেকেই চা যেন আমার স্নায়ুকে শাসন করছে।
দক্ষিণ কলকাতার আলটিমেট টি ডেস্টিনেশন .... ঢাকুরিয়া দক্ষিণাপণের ‘ডলি’স দ্য টি শপ’।
ছোট্ট ঘর। ঢুকলে চা চা গন্ধ। চায়ের পেটি, ছোটো বড় চায়ের বাক্স ঘরের চারিদিকে। বাইরে ছোট্ট বাগান .. সেখানে চেয়ার আর মোড়া রাখা। গোল হয়ে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডা জমে ক্ষীর। পুরো মাখন। মেনু কার্ডে চোখ রেখে চা পুরাণ পড়তে পড়তেই পরিচয় হল মিসুকে গরজাস মহিলার সঙ্গে।
ডলি রায় (বয়স ৬১) বয়সের ছাপ পরলেও সেই আভিজাত্য এখনও আছে। দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে বেড়ে ওঠা। আর সেটাই বোধ হয় ডলির চায়ের সঙ্গে এক অন্যরকম যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল শৈশবেই। চায়ের প্রতি প্রেম তো ছিলই। তখন কি আর জানতেন আগামীটা এমন হবে। কলকাতায় হাসপাতালে ডায়াটিসিয়ানের চাকরি নিয়ে চলে আসেন। ডায়েটের কনসেপ্টটা তখন আনকোরা। তাই তাঁকে বুঝতে অসুবিধেই হত। সাল ১৯৭১। খবরের কাগজের একটা বিজ্ঞাপণই বদলে দিল তাঁর জীবন। Tea Board of India তখন বিদেশে ভারতীয় চায়ের পসার বাড়াতে 'tea ambassador' এর খুঁজছে। চাকরির আবেদন জমা দিলেন, আর ভাগ্যক্রমে সেই পদে নিযুক্ত হয়ে গেলেন ডলি রায়। শুরুতেই প্রথম বছর দার্জিলিং-এ। তখন হাতে কলমে সব শিখে নিচ্ছেন। সাগর পারে তিনিই তখন ভারতীয় চায়ের মুখ। পাঁচ বছর বেলজিয়ামে থাকার পর বছর খানেক নিউইয়র্কে। একাধিক ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। সাতাত্তরে টি বোর্ডের চাকরি ছেড়ে দেন। দশ বছর পর শুরু হয় তার স্টার্টআপ। শহর কলকাতার দক্ষিণের মানুষদের ভালো চায়ের হদিস দিতে তৈরি করে ফেললেন ‘ডলি’স দ্য টি শপ’।
আজ নয়, গত সাতাশ বছর ধরে শুধু চা খাওয়ান না, গোটা কলকাতাকে চা-সচেতন করার চেষ্টা করেন। এই সময়কালে মোবাইল, ইন্টারনেট, মাল্টিপ্লেক্স, শপিংমল এসেছে। ডলির চা সময়ের স্রোতে গা ভাসায়নি। এসি-র আরামের তোয়াক্কা করে না। গুণগত মান বজায় রাখাই লক্ষ্য। দেশ বিদেশের নানান চা, আসাম, দার্জিলিং, নীলগিরি, উত্তরাঞ্চল তো আছেই সেই সঙ্গে চিন, বেলজিয়ামের চা-ও পাবেন এখানে। অপর্না সেন –ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে একেলে পরমব্রত-স্বস্তিকারাও আসেন। নানান চায়ের খোঁজ করেন। স্রেফ গরম চা নয়, খোঁজ করেন আইস টি-রও। কলকাতায় প্রথম আইস টি নাকি তাঁরই আনা। বলছিলেন, ভারতের প্রথম মহিলা টি টেস্টার এবং বিশ্বের প্রথম মহিলা টি অকশনার ডলি রায়।
গ্রিন টি তো আছেই। সঙ্গে তরমুজ-আনারস দিয়ে তৈরি বিশেষ পানীয়। চায়ের সঙ্গে টোম্যাটো জুস মিলে হয়ে গেল টি-টোম্যাটো। সুগন্ধী লিকারের সঙ্গে ফিস ফ্রাই খাবেন? না, গরমে ঠান্ডা চায়ে চুমুকের ফাঁকে একটা স্যান্ডউইচ? চায়ের সঙ্গে টা-র ব্যবস্থাও মন্দ নয়! আর এক ‘টা’ হিসেবে মিলবে সপ্তর্ষির বাছাই করা বই। টেবিলের ওপর সাজানো আছে। তাই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় গিয়ে কফি হাউসের আড্ডা নয়। কোনও মনখারাপের বিকেলে দক্ষিণাপণে ডলির চা ঘরে চায়ে চুমুকের ফাঁকে বইয়ের পাতা ওল্টাতে পারেন।
চা-ময় জীবন ডলির। এখনও নিয়ম করে রোজ বিকেলে দোকানে আসেন। এক কোণে বসে খুঁটিয়ে দেখেন।আপ্যায়ন করেন। দোকানে ক জন কাজ করেন? তাঁর সহাস্য জবাব কাস্টোমাররাই নাকি তাঁর ওয়ার্কার। গিফ্ট-প্যাকে বা বাড়ির জন্য পছন্দের চা-পাতা কেউ নিয়ে গেলে আজও ডলি পরামর্শ দেন, এক কাপের জন্য কিন্তু সবসময় এক চা-চামচ পাতাই বরাদ্দ।