স্বপ্ন দেখার ঝুঁকি নিয়েছিলেন স্বপনকুমার

স্বপ্ন দেখার ঝুঁকি নিয়েছিলেন স্বপনকুমার

Monday December 14, 2015,

4 min Read

ছোটোবেলা থেকেই দুনিয়াটাকে উল্টেপাল্টে ওমলেটের মতো ভাজা ভাজা করে দেখতে চাইতেন স্বপনকুমার। না রহস্য রোমাঞ্চ লেখক শ্রী স্বপনকুমার নন। ইনি টালিগঞ্জ নেতাজি নগরের ছেলে স্বপনকুমার মুখার্জি। এঁর জীবনের রহস্যও কম নয়। কেননা গোটা জীবনটাই রোমাঞ্চের পিছনে ছুটেছেন এই কাহিনির নায়ক।

image


বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে একদিন ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেয়ার ব্যবসার উথাল পাথাল সমুদ্রে। কষ্টার্জিত অর্থ গোটাটাই বিনিয়োগ করলেন আপাত দুরূহ এই বাজারে। All is Well মন্ত্রের মতো মনে মনে জপে গেছেন No Risk, No Gain প্রবাদটি। চাকরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে 'লক্ষ্মীকে হারাই যদি অলক্ষ্মীরে পাবোই' গোছের অ্যাটিটিউড নিয়ে সেই যাত্রা শুরু। অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে পার্টটাইমের কাজ আর বাজারে লগ্নি করেই এক্কেবারে বিন্দাস স্বপনকুমার। বাড়তে লাগল ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখও মিটল। 

বরাবরই ঝুঁকি নিতে ভালোবাসতেন স্বপন। এক সময় দুর্দান্ত খেলোয়াড় ছিলেন। পাড়া-ক্রিকেটে হিরো। বরাবরই দশটা-পাঁচটার কেরানিগিরি তাঁর না-পসন্দ। কিন্তু বাধ্য হয়েই এক সময় চাকরি খুঁজতে হয়। পেশায় অ্যাকাউন্টেন্ট স্বপন কয়েকটি ছোটখাটো চাকরি করার পর, পেয়ে যান আক্ষরিক অর্থেই ভালো চাকরি। বহুজাতিক সংস্থা ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজে। ১৯৮৮ সালে বেতন যা পেতেন তাতে চোখ টাঁটাত আত্মীয়স্বজন। তবু, তৃপ্ত ছিলেন না। কারণ চাকরি তো দিনের শেষে চাকরিই। বাঁধা মাইনে। দশটা পাঁচটা। বছর ঘুরলে ইনসেন্টিভ। কালেভদ্রে প্রোমোশন।

রাইটার্সের পিছনে ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে দিয়ে গেলেই এক অমোঘ টান টের পেতেন। একবার দুবার। ধীরে ধীরে সময় পেলেই চলে যেতেন কলকাতার শেয়ার বাজারে। অবাক হয়ে দেখতেন মানুষের হাতের নানা মুদ্রায় বদলে যাচ্ছে এক-একজনের ভাগ্য। স্বপনের কথায়, “সেই সময় কলকাতার শেয়ার বাজারে বাঙালি বিশেষ চোখেই পড়ত না। অবাঙালিদেরই ভিড়। নিবিড়ভাবে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করতাম। শেয়ার সংক্রান্ত প্রচুর বইপত্র পড়তাম। সাহস করে একদিন লগ্নিও করে ফেললাম। তবে রীতিমত বুদ্ধি খাটিয়ে। অন্ধের মতো নয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল অচিরেই। লাভের মুখ দেখলাম। এই ভাবে প্রতি মাসেই বেতনের কিছু অংশ লগ্নি করতাম শেয়ারে। এক দিন ঠিক করলাম, চাকরি ছেড়ে দেব। আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি পরিবারের কেউই। অশান্তি হয়েছে। বন্ধু-বান্ধবেরা পাগল বলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে। কিন্তু আমি জেদ ধরে ছিলাম। চাকরির সীমিত উপার্জনে মন ভরছিল না। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতাম। ছোটোবেলায় শুনেছিলাম, নো রিস্ক নো গেইনের প্রবাদবাক্যটি। মাথার ভিতরে সেই কথাটাই ঘুরত। এক দিন সত্যি-সত্যি নিশ্চিন্তের চাকরি ছেড়েই দিলাম।“

সেটা ১৯৮৯ সাল। আজকের শেয়ার বাজারের সঙ্গে আসমান-জমিন ফারাক সেই যুগের শেয়ার বাজারের। বাঙালিদের ভিতর শেয়ার নিয়ে তখনও বিশেষ কোনও আগ্রহ তৈরি হয়নি। শেয়ার বাজারের কাজকর্মের ধরণধারণও ছিল অন্যরকম। বৈদুতিন যুগের মতো এতো অনায়াস ছিল না কেনাবেচা। হাতের বিভিন্ন মুদ্রায়, ইশারা-ইঙ্গিতে কেনাবেচা হত। পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল ১৯৯৫ সাল থেকে। বৈদুতিন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে কেনাবেচা শুরু হল। কিন্তু যেটা বদলালো না, সেটা হল ঝুঁকি। অন্ধের মতো শেয়ার বাজারে লগ্নি করলে ডুবতে হয়, এটা প্রথম দিন থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন স্বপন। তাই প্রতিটি পদক্ষেপই করতেন সাবধানে, যথেষ্ট পড়াশুনোর পর, বুদ্ধি খাটিয়ে। শেয়ার বাজারে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে যে উপলব্ধি স্বপনের, তা হল, উত্থান-পতনের সঙ্গে লড়াই করতে শিখতে হবে। এক বার লোকসান হলেই মুষড়ে পড়লে চলবে না। কেন লোকসান হল, তার সঠিক কারণ জানতে হবে। নিজের ভুল হলে শোধরাতে হবে তা। স্বপনের বক্তব্য, “অতি লোভীদের জন্য শেয়ার বাজার নয়। উপার্জনের খিদে যেমন থাকবে, তেমন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণটি হল সবদিক বিবেচনা করে পদক্ষেপ করা। চটজলদি লাভের ফাঁদে যাঁরা পড়বেন, তাঁদের ভরাড়ুবি নিশ্চিত।“

কিন্তু নিশ্চিন্তের চাকরি ছেড়ে শেয়ার কেনাবেচার ঝুঁকিবহুল জীবনে এসে কী পেলেন? স্বপনের চট্‌জলদি জবাব, “স্বাধীনতা! চাকরির ধরাবাঁধা রোজগার এবং দশটা-পাঁচটার জীবন থেকে মুক্তি।“ তাঁর কথায়, “দেখুন, ভ্রমণ আমার নেশা। চাকরি করে বিদেশ-ভ্রমণ করা বেশ কষ্টকর। এক জন সাধারণ চাকুরিজীবীকে অনেক ভেবেচিন্তে বিদেশ-ভ্রমণ করতে হয়। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা সেই রকম নয়। শেয়ার বাজারে অর্থলগ্নি করে জীবনে যে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে, চাকরি করে তা কোনও দিনই আসতো না। এখন পরিবারের মানুষজনকে নিয়ে বছরে অন্তত দু-বার বিদেশ-ভ্রমণের যে ক্ষমতা, তা কিন্তু এসেছে শেয়ার বাজারে লগ্নি করেই।“

image


স্বপন মনে করেন, আগের তুলনার পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। আজ বাঙালি যুবকেরা শেয়ার বাজারে লগ্নি করায় আগ্রহী। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দেশ এবং বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি, কোম্পানিগুলির ব্যবসার উত্থান-পতনের কোনও স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই অনেকে লগ্নি করছেন। এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন অচিরেই। এঁদের জন্য স্বপনের পরামর্শ:

  1. প্রাথমিকভাবে ব্লু-চিপ কোম্পানিগুলিতে দীর্ঘমেয়াদি লগ্নি করুন।
  2. অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় অন্ধের মতো লগ্নি করবেন না। 
  3. নিছক ধারণার বশে শেয়ার কেনাবেচা কখনওই নয়। 
  4. কেনাবেচা কেন করছেন সে বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকলে, তবেই এগোবেন।
  5. বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
  6. প্রথমেই বেশি পরিমানে লগ্নি করতে যাবেন না। গো স্লো, বাট গো স্টেডি।
  7. কোনও কোম্পানির শেয়ার কেনার আগে ভালো করে জেনে নিন সেই কোম্পানির আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি, কোম্পানির লভ্যাংশ বন্টনের খতিয়ান।
  8. প্রাথমিক অবস্থায় কখনওই সঞ্চয়ের টাকা শেয়ার বাজারে খাটাতে যাবেন না।
  9. নিজের ওপর আস্থা হারাবেন না।

নিজের প্রতি আস্থা না হারালে জীবনে দাঁড়ানো যে শুধু সম্ভবই না বরং অন্য়ের আস্থাও অর্জন করা যায় তাই দেখিয়ে দিয়েছেন স্বপনকুমার। জীবনের বাধা টপকে স্বপনকুমারের স্বপ্ন আজ সার্থক। ওঁর মনের জোর আর খেলোয়াড়ি মানসিকতাই ওকে শেয়ার বাজারে এবড়ো খেবড়ো পিচে সাফল্য পেতে সাহায্য করেছে।