ইনি আরেক বাল্মীকি। কবি। তবে সবজি বিক্রেতা কবি। যখন স্কুলে পড়ত সারাদিন মন দিয়ে লিখেই যেত মুখচোরা ছেলেটি। তাই দেখে সবার মনে হয়েছিল ভালই ফল হবে। কিন্তু এ কী কাণ্ড! নম্বর হাতে পেয়ে বেশ সন্দেহই হল মাস্টারমশাইদের। এমনতো হওয়ার কথা না। মাধ্যমিকে সব বিষয়ে শূন্য! গন্ডগোল কোথাও একটা হয়েছেই। ঠিকই, একটা গন্ডগোল হয়েছিল বটে। পরীক্ষার খাতায় পাতার পর পাতা কবিতা লিখে এসেছিল তপন। নম্বর দেওয়ার উপায় ছিল না। কর্তব্যে অবিচল থেকে শূন্যই বসিয়েছিলেন পরীক্ষকরা।
তপন দত্ত। সেদিনের সেই মাধ্যমিকে ফেল করা ছেলেটির বয়স এখন ৪০ ছুঁই ছুঁই। পড়াশোনাও বেশিদূর গড়ায়নি। গড়াবেই বা কীকরে, কবিতার ভুত যে পিছু ছাড়েনি। কবিতা লিখে তো পেট ভরবে না। অগত্যা সবজি বেচা। তাতে কোনও রকমে পেট ভরলেও মন ভরে না। কবিতা পাগল তপন সবজি বেচতে বেচতেই ছন্দ মেলান। ‘কবিতা লিখলে কী পেট ভরবে?’, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওঠেন অভাবী মা। ওসব এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। হুগলির কেওটা টাওয়ারবাগানে রাস্তার ওপর সবজির পসরা সাজিয়ে হাঁক পাড়েন তপন, ‘টাটকা বেগুন, চাষের মেথি শাক। খারাপ হলে পয়সা থাক’। ক্রেতাদের হাতে সবজির ব্যাগ তুলে দিতে দিতে চলে ছন্দ মেলানো। কেউ কেউ আড়চোখে দেখেন আর মনে মনে বুঝি বলেন, ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’।
কেওটা টাওয়ারবাগানের আট বাই আট ফুটের একচিলতে ঘরে তপনের কবিত্বের সুতিকাঘর। এখনও ওই ঘরে বসেই পাতার পর পাতা কবিতা বোনেন। লিখেছেন নাটকও। সব লেখাই সুমন বাল্মীকি ছদ্মনামে। দু একটা ছোট-বড় ম্যাগাজিনে লেখা বেরিয়েছে। পাঠকের প্রশংসাও কুড়িয়েছে। দু একটা স্বীকৃতি জুটেছে। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। তার বেশি আর ভাগ্য খোলেনি। তবু কলম থামেনি। কখনও আধপেটা খেয়ে, কখনও কাছের মানুষগুলোর অবজ্ঞার পাত্র হয়েও সুমন বাল্মীকির কলম কবিতার ক্যানভাসে রাজাধিরাজ।
কিন্তু ছদ্মনাম সুমন বাল্মীকি কেন? তপন জানান, লেখা তো আমার ধ্যান, জ্ঞান স্বপ্ন। আরও একটা চাওয়া আছে। গায়ক, কবিয়াল কবীর সুমনকে ছুঁতে চাই। বহু চেষ্টা করে একবার কবীর সুমনের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন নাকি, আবার দেখা হবে।
লেখার কথা জিজ্ঞাসা করলেই চোখ চিকচিক করে ওঠে। বলেন, ‘শুধু লিখতে চাই। আমায় খেতে দিতে হবে না। শুধু লেখার রসদটুকু পেলেই হবে। কিন্তু কেউ বোঝে না। না খেতে পাওয়া কবিদের ভিড়ে আমিও হারিয়ে যাই’। সংসার যে বড় কঠিন ঠাঁই। স্ত্রী, পুত্র, বৃদ্ধা মায়ের মুখে অন্ন তুলে দিতে সকাল-সন্ধের সংগ্রাম। প্রতিদিন ভোরবেলা সুমন বাল্মীকিকে আলু, পটল, বেগুন নিয়ে বাজারে পশরা সাজিয়ে বসতে হয়। আর ফাঁক পেলেই হিসেবের খাতা ভরে ওঠে-
মনে রেখো আমারও কিছু করার নেই।
জলে গেল, জলের রচনা
চাঁচ উলটে, চলছে আলোচনা
দল বদলে নিজে আগে বাঁচি,
ঘুড়ির সুতোয় আছি যতক্ষণ।