ঐতিহ্যকে বাঁচিয়েই আধুনিকতায় মিশছে ভুটান
দ্য ল্যান্ড অব থান্ডার ড্রাগন। এই নামেই পরিচিত পূর্ব হিমালয়ে অবস্থিত ভুটান। উত্তরে চিন, বাকি সব দিকে ভারত। সুউচ্চ পর্বতমালা, উর্বর উপত্যকা ও ঘন জঙ্গল, এই নিয়েই প্রকৃতির কোল আলো করে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশটি। ভুটান বলতে চোখের সামনে আরও ভেসে ওঠে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও মনাস্ট্রি। গত কয়েক দশকে পরিবর্তনের হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে ভুটানকেও। লেগেছে বিশ্বায়নের ছোঁয়া। আশির দশকে ভুটানের ৯৫ শতাংশই ছিল গ্রামীণ এলাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশ। আধুনিকতার স্পর্শে জেগে উঠেছে রাজধানী থিম্পু। সেলফোন নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন দলে-দলে মানুষ। বাজার ছেয়ে ফেলেছে ভারত থেকে আসা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেলফোন। ফুন্টশেলিংয়ে (ভুটানের সীমান্ত শহর) সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে মালবাহী ট্রাক। হরেক সামগ্রী নিয়ে ট্রাক ঢুকছে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে।
ভুটানের জনসংখ্যা খুবই কম। একটি সূত্র অনুযায়ী সাত লক্ষ পয়ষট্টি হাজার। জনসংখ্যা যাই হোক, হিমালয়ের কোলে থাকা ছোট্ট এই দেশ এখন এগিয়ে চলেছে ঐতিহ্য আর আধুনিকতাকে সঙ্গী করে। দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
কয়েক শতকের রাজতন্ত্রকে বিদায় জানিয়ে দেশে এখন গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার। ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিকতার স্বাদ নিচ্ছেন দেশের মানুষ। স্বাগত জানাচ্ছেন আধুনিক প্রযুক্তিকে। সেই লক্ষ্যেই থিম্পুতে গড়ে উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক। থিম্পুর উপকন্ঠে বাবেসায় ২০১২ সালে গড়ে তোলা হয়েছে থিম্পু টেক পার্ক।
সম্প্রতি এক মাসের জন্য ভুটান গিয়ে আলাপ হয়েছিল Bhutan Innovation and Technology Centre (BITC)-র সিইও ডক্টর সিগাইয়ের সঙ্গে। ভুটানে তথ্যপ্রযুক্তি কীভাবে এগোচ্ছে তার একটা ছবি পাওয়া গেল তাঁর থেকে। সিগাইয়ের কথা থেকে জানা গেল, থিম্পু টেক পার্ক গড়ে তোলার পর দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এখানে কাজ শুরু করেছে। তাতে যে তরুণ সমাজের কর্মসংস্থানের চাহিদা মিটে গিয়েছে এমনটা নয়। কিন্তু শুরুটা হয়েছে। আর সেটাকেই তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে পড়াশোনা করেছেন ডক্টর সিগাই। বিদেশি কোম্পানিতে কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। হয়তো সেভাবেই চালিয়ে যেতেন। কিন্তু দেশে ফেরার ডাক অগ্রাহ্য করতে পারেননি। বিশেষ করে থিম্পু টেক পার্ক। শুরুটা করেছিলেন COO হিসাবে। এই পার্ক গড়ে তুলতে যতটা সম্ভব করেছেন তিনি। এখন CEO হিসাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সোনম ছোড়েন-সহ ১৪ জনের একটা দল। তারাই সামলাচ্ছেন টেক পার্কটি। এখানে যে সব সংস্থা ব্যবসা করছে তার মধ্যে অন্যতম বড় সংস্থা হল ScanCafe. দুশোরও বেশি ভুটানি তরুণ এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। মার্কিন এই কোম্পানিতে মূলত ফটো স্ক্যানিং, রেস্টোরেশন, ভিডিও এডিটিং ইত্যাদি কাজ হয়। ব্যবসা আপাতত ভালোই চলছে। কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায় তার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। যাতে অন্তত ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়।
যত বেশি বেশি সম্ভব তরুণের কর্মসংস্থান। সেটাই লক্ষ্য থিম্পু টেক পার্কের। কর্মসংস্থান বাড়াতে পার্কে আমন্ত্রণ জানান হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের দেশি-বিদেশি সংস্থাকে। আসলে তরুণদের যথাযথ কাজের ব্যবস্থা করাটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ভুটান সরকারের কাছে। তরুণ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে অনেকেই বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। এর বেশিরভাগই পড়তে যান ভারতে। ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরার পরেই দেখা দেয় সমস্যা। উপযুক্ত কাজ নেই। ডক্টর সিগাই জানালেন, তাঁদের দেশে এখন ইংরেজি জানা প্রায় দশ হাজার গ্র্যাজুয়েট কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিদেশি কোম্পানি এলে এই মানবসম্পদকে সহজেই কাজে লাগাতে পারবে। তাতে দু'পক্ষেরই লাভ। থিম্পু টেক পার্কে ব্যবসা করছে বাংলাদেশি কোম্পানি SouthTech. রয়েছে সুইজারল্যান্ডের Selise. এই সংস্থা ওয়েব টেকনোলজি ও সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ করে থাকে। Selise-এর এক তরুণ ভুটানি আইটি কর্মী জানালেন তাঁদের অধিকাংশ ক্লায়েন্ট ইউরোপ-আমেরিকার। ব্যাঙ্কিং, মাইক্রোফাইন্যান্স, হিউম্যান রিসোর্স, রেস্তোরাঁর জন্য সফ্টওয়্যার বানিয়ে থাকে SouthTech। সবমিলিয়ে টেক পার্কের ছবিটা যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, তবে বৃ্দ্ধির গতি প্রত্যাশার তুলনায় কম।
ভুটানে ই-কমার্সের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। ই-কমার্সের যেটুকু উপস্থিতি তা সীমাবদ্ধ বিমান টিকিটের মধ্যেই। ই-কমার্স সাইট সন্ধান করতে গিয়ে খোঁজ মিলল কেবল Shop.bt ও Hotel.bt-র। তবে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে।B-Bay, Best Buy, Sell in Bhutan এমনই কয়েকটি। এইসব গ্রুপের মেম্বারশিপ প্রায় পঞ্চাশ হাজার। জিনিস বিক্রির বিজ্ঞাপন মেলে এইসব গ্রুপে। ব্যাঙ্কে ক্রেডিট কার্ড মেলে, তবে সাধারণের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার খুব কম। ব্যাঙ্কে ইন্টারনেট ও এসএমএস ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধা থাকলেও, ওয়েব লেনদেনের ব্যবস্থা নেই।
থিম্পু টেক পার্কে কাজ করছে এমন আরও কয়েকটি সংস্থার মধ্যে নাম করতে হয় NGN Technologies, iTechnologies, Yangkhor IT Solutions, eDruk, Athang-র। এই সব সংস্থারই মূল ক্লায়েন্ট বলতে ভুটান সরকার। বেসরকারি ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট পেতে আরও সময় লাগবে বলেই মনে করা হচ্ছে। ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস কোম্পানিগুলিরই খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি রয়েছে অনলাইনে। হওয়াটাই স্ভাবাবিক। এই ক্ষেত্রে ব্যবসার পরিমাণও বেশি। তাই আশা করা যায় টেক পার্কের সংস্থাগুলি এদের মাধ্যমে কাজ পেতে পারে। ভুটানের অর্থনীতিতে অনেকটাই অবদান রাখে পর্যটন ক্ষেত্র। তবে পর্যটনের দ্বার বিদেশিদের জন্য অবাধ করা হয়নি। ভারত, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের বাসিন্দাদের ভূটানে প্রবেশের জন্য ভিসা লাগে না। কিন্তু অন্য যে কোনও দেশের পর্যটকদের দৈনিক প্রায় ২৫০ মার্কিন ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত মাথাপিছু দিতে হয়। এর মধ্যে ধরা থাকে কমপক্ষে থ্রি স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, সব ধরনের খাওয়াদাওয়া, সর্বক্ষণের জন্য একজন লাইসেন্সড ভুটানি গাইড, সমস্ত অন্তঃর্দেশীয় ট্রান্সপোর্ট (বিমান বাদে), ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা। যারা ইচ্ছুক যোগাযোগ করতে পারেন www.tourism.gov.bt সাইটে। আসলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতেই এত কড়াকড়ি। তবে ভুটানের নৈশজীবন বেশ আকর্ষণীয়। উইকএন্ডে পাব খোলা থাকে রাত দুটো পর্যন্ত। আর তরুণ প্রজন্মও খুবই স্বচ্ছন্দ ফেসবুক- ইনস্টাগ্রামে।
স্থানীয়দের মধ্যে ব্যবসা বা উদ্যোগিক মানসিকতা কিছুটা হলেও কম। আসলে ব্যবসা বা কারখানা গড়ে তোলা বিষয়টা স্থানীয়দের কাছে ততটা সহজ নয়। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে প্রচেষ্টা ও সময় দুই-ই লাগবে। তবে কেউ ব্যবসা করছেন না এমনটাও নয়। টেক পার্কেই রয়েছে ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানি Thunder Motors. যা গড়ে তুলেছেন স্থানীয় উদ্যোগপতি Tashi Wangchuk. অনেক বাধাবিপত্তি, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কারখানা গড়েছেন থাসি। তাঁর লক্ষ্য ২০১৭ সালের মধ্যে থান্ডারকে আন্তর্জাতিক করে তোলা। তিনি চান তাঁর গাড়ি বের হোক বিশ্ববিখ্যাত নিশানের কারখানা থেকেও। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ুক তাঁর কম পয়সার চারচাকা গাড়ি।থাসির এই সাফল্যই অনুপ্রাণিত করছে স্থানীয় তরুণদের।
একটি দেশে কয়েকদিন কাটিয়ে সবটা বুঝে ফেলা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির প্রবেশ এখনও সেভাবে হয়নি। তবে পরিবেশ আর পরিস্থিতি বলছে, সেদিন আর দেরি নেই। নগরায়ন হচ্ছে, বাড়ছে কর্মসংস্থানের চাহিদা, স্বভাবতই প্রযুক্তিকেও এড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। ঐতিহ্যকে বাঁচিয়েই তাই নতুন দিনের পথ চেয়ে রয়েছে ভুটান। দরজা একটু খুলেছে, সেখান দিয়েই আপাতত ঢুকছে প্রযুক্তির বাতাস।
(এই প্রবন্ধের লেখক জুবিন মেহতা সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন ভুটান)