অবজ্ঞা, অপমান, লড়াইয়ের পর সাফল্য এসেছে মনোজের
কথায় আছে হাজারটা খারাপ দিনের চাইতে একটি ভালো দিনের গুরুত্ব বেশী। হাজার সমস্যা বা দুঃখের শেষে ষদি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌছতে পারলে ঠিক যেমন পথের সারা ক্লান্তি কেটে যায় ঠিক তেমনই। তবে ভালো দিন দেখতে গেলে বা নিজের লক্ষ্যে পৌছতে গেলে অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পথের মাঝে হাল ছেড়ে না দিয়ে নিজেকে সামলে আবার এগিয়ে চলার সাহস রাখতে হবে। ওই সাহস আর জেদের মিশেলই আপনাকে একজন সফল মানুষ হিসাবে আপনাকে গড়ে তুলবে । তবে তখনই আপনাকে একজন প্রকৃত বড় মানুষা বলে লোকে জানবে, যখন সাফল্যের আকাশ ছুঁয়েও আপনি আপনার পুরনো মাটিকে ভুলে যাবেন না, যেখানে আপনার সাফল্যের শিকড় রয়েছে । এই সবকিছুর মিশেল ষদি কোনও এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে খাটে, সেই ব্যক্তির নাম মনোজ তিওয়ারি ।
বর্তমানে উত্তর পূর্ব দিল্লির সাংসদ মনোজ তিওয়ারির পক্ষ্যে এই পথ পাড়ি দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু কথায় আছে , সাহস করে যারা হাজারো সমস্যা কাটিয়ে পথে চলতে থাকেন তাদের জন্য রাস্তা আপনা আপনিই তৈরী হতে থাকে। ইয়োর স্টোরির সঙ্গে আলাপচারিতার মনোজ তিওয়ারি নিজের জীবনের এমন অনেক অজানা দিক মেলে ধরলেন । প্রত্যেক সমস্যাক্রান্ত মানুষের জীবনে যা অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে ।
বিহারের কৌমর জেলার বাসিন্দা মনোজ তিওয়ারি নিজের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে বললেন।
“গ্রামের আর পাঁচটা ছেলের মতই আমার ছোটবেলা কেটেছে। হাজার সমস্যা ছিল। প্রতিদিন চার কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতাম। হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি, গ্রামের অভাবী বাচ্চাদের কাছে সেটাই ছিল স্কুলের ইউনিফর্ম। ’’
যে পরিস্হিতি ও সময়ের মোকাবিলা করে মনোজ তিওয়ারি আজ এই যায়গায় পৌছেছেন মনোজ তিওয়ারি। আজ তার কাছে তা স্বপ্নের চাইতে কোন অংশে কম নয়। তার এই সাফল্য ভগবানের আর্শীবাদেই সম্ভব হয়েছে বলে মানেন তিনি। কেননা যে পরিস্হিতিতে তার ছোটবেলা কেটেছে তার নিরিখে এই সাফল্য সত্যিই অকল্পনীয়। ছোটবেলায় বাবাকে হারান মনোজ। তার পর সংসারের সারা দায়িত্ব তার মায়ের উপর গিয়ে পড়ে। তার মা একাই মনোজের বাবা মায়ের বায়িত্ব সামলেছেন। মায়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মনোজ, চোখে জল আসে তার। গর্বের সঙ্গে বললেন, “ আজ আমি যা হবে পেরেছি তা শুধু কেবলমাত্র আমার মায়ের জন্য সম্ভব হয়েছে। মা সারা জীবন আমার জীবনের প্রতিটি বাঁকে পথ দেখিয়েছেন। আজও তিনি তাই করে চলেছেন। মায়ের কোনও সমস্যা হলে আমি কষ্ট পাই। আবার মায়ের মুখে হাসি দেখলে আমার আনন্দ হয়। এজন্য আমি মায়ের সব ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করি। ”
স্কুলে সরকারি স্কলারশিপের টাকাতেই মনোজের পড়াশোনা । কিন্তু স্কুলের পর পড়াশোনা চালাতে গিয়ে বিস্তর সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাকে। তিনি বললেন , “ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ১৯৯২ সালে আমি গ্রাজুয়েশন করি। সেসময় অনেক কষ্ট করেছি । আমি জানতাম মা কত কষ্ট করে আমার পড়ার টাকা জোগার করছেন। ফসল বেচে হাতে টাকা পেলে, মা আমার পড়ার খরচ পাঠাতেন। কখনও ফসল নষ্ট হলে সমস্যা আরও বাড়ত। ” কোনরকমে পড়াশুনোর পাঠ মিটল। চাকরির চেস্টা করলেন । কিন্তু চাকরি জুটল না। সেসময় মনোজ বুঝলেন যে তিনি ভাল গান গাইতে পারেন।
এরকম একটি ঘটনার কথা ইয়োর স্টোরিকে বললেন মনোজ। বললেন, “ গ্রাজুয়েশনের পর চাকরি না পেয়ে ভাবতাম এখন কি করা যায়। সেসময় ১৯৯২ সালে একটি অনুষ্ঠানে গান গাই। গান গেয়ে ১৪০০ টাকা পেলাম। তখন আমার মাথায় এল আমি প্রফেসনালি গান গাওয়া শুরু করছি না কেন। বাবার গানের ঐতিহ্যকে কেন আরও আগে বাড়াবো না সেসময় দিল্লি আসি ।এক সাংসদের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাকতাম। লোকজনকে নিজের গান শোনাতাম। গান গেয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। ওই চার বছরে লোকজেনর অনেক অপমান সয়েছি। কতবার আমায় গলাধাক্কা দিয়ে লোকজন অফিস থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু আমি হার মানিনি । চেষ্টা করে গেছি। কথায় আছে আপনার যদি প্রতিভা থাকে তাহলে একদিন সুযোগ ঠিকই আসে । আমার জীবনেও তাই হল। টি সিরিজের মালিক গুলসন কুমার একদিন আমার গান শুনলেন । তারপর আর আমি কোনদিন পিছন ফিরে তাকাইনি । আমার গান সুপার হিট হল। ”
পঞ্জাবি কবি অবতার সিং পন্থ বলেছিলেন, “সবচাইতে ভয়ঙ্কর হল স্বপ্নের মৃত্যু হওয়া” । মনোজ তিওয়ারিও একই কথা বলেন। তার মতে তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে হবে কোন পথে তারা হাঁটতে চাইছেন। তার পর ঠিক করুন ওই পথে তার কি স্বপ্ন রয়েছে । তারা যদি স্বপ্ন না দ্যাখেন , তাহলে তা কখনও পুরো হবে না । মনোজ তিওয়ারি বললেন ,“ আমি জীবনে তিনটে স্বপ্ন দেখেছিলাম ,যা সফল হয়েছিল। প্রথম স্বপ্ন ছিল কোন ধনী পরিবারের মেয়ে আমার গান শুনে পছন্দ করবে। দ্বীতিয় স্বপ্ন ছিল অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা করব । আর তিনি তার ছোলে অভিষেকের সঙ্গে আমার পরিচয় করাবেন। এই স্বপ্নও পুরোপুরি সত্যি হয়েছিল। আমি যশরাজ ফিল্মসের অফিসে অমিতজির সঙ্গে দেখা করি। সঙ্গে অভিষেক বচ্চনও ছিলেন । অর ঠিক সেরকমই হয়েছিল যেরকম স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। গ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে নিয়েও এরকম স্বপ্ন দেখতাম। তবে অসুস্হতার কারনে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি গেলেই মনে হয় এখানেই অটলজি থাকতেন। তা ভেবেই রোমাঞ্চিত হই। ”
তাও মনোজের একটি স্বপ্ন আজও অধরা। তা হল ভোজপুরিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষার মর্যাদা দেওয়া । তার কথায় “ভোজপুরি আমাদের মায়ের মতন। এর মত মিস্টতা খুবই দূর্লভ । যখন অন্য দেশে ভোজপুরিকে সন্মান করা হয়, তখন আমাদের দেশে তা অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে। যেহেতু ভোজপুরি মায়ের সমান,তাই মায়ের সন্মান পাওয়াটা জরুরি । আমার আশা ২০-২২ কোটি লোকের ভাষা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিচার করবেন। ভোজপুরিকে ভাষার মর্যদা দেওয়ার লড়াইতে লেগে আছি ।”
মনোজ তিওয়ারি বর্তমানের মাটিতেই থাকতে পছন্দ করেন। একারণেই নানান ধরনের কাজ করলেও তার নিষ্ঠার জন্যই প্রতি কাজে সফল হন। এজন্য সবসময় তিনি বর্তমান সময়ের কদর করেন।
সফল তিনিই হন যিনি নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেন। সার্থক সেই ব্যক্তি যিনি নিজের ভিতরের খামতি ও প্রতিভার কদর বোঝেন। আদর্শ ব্যক্তি তিনি যিনি জীবনের নানা ঝড়ঝাপটা সামলেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। আর লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেন। এই তিনি পরিস্থিতিতেই নিজেকে সামলে এনেছেন মনোজ। তার সাফল্যা তিনি নিজেই অর্জন করেছেন। কোটি কোটি মানুষের মনে তা প্রেরণা যোগাচ্ছে।
(Translated by Sujoy Das)