ভারতের মত বিশাল দেশের উন্নয়ন যে শুধু অর্থনীতির বৃদ্ধির নিরিখে মাপলে হবে না। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, হস্তশিল্প সব ক্ষেত্রের সামগ্রিক উন্নয়ন ও নতুন চিন্তাভাবনার উন্মেষেই তা সম্ভব। এই মন্ত্রকে মূল করে চার বছর আগে শুরু হয়েছিল সামাজিক ক্ষেত্রে দেশের উঠতি উদ্যোগপতিদের স্বীকৃতি দেওয়া। উদ্যোক্তা টাটা গোষ্ঠী। টাটা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ চ্যালেঞ্জ শুরু হয় এভাবেই। আজ চার বছর পর দেশের সামাজিক উদ্যোগের স্বীকৃতির ফিল্ম ফেয়ার বলে পরিচিত এই পুরস্কার। সম্প্রতি আই আই এম কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল তার গ্র্যান্ড ফিন্যালে।
আই আই এম কলকাতার ইনোভেশন পার্কের ডিরেক্টর প্রফেসর অশোক ভট্টাচার্য তার বক্তৃতায় বেঁধে দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানের মূল সুর । বলেন, “সোশ্যাল অন্ত্রেপ্রিনিওরশিপ আসলে সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধান খোঁজা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা চাই এই পথচলার মাধ্যমে ভারতের সামাজিক উদ্যোগপতিদের সঠিক দিশা দেখিয়ে পরিবর্তনের অংশীদার করতে। ” তার দাবি গত চার বছরে এই পুরস্কারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রছাত্রী, উদ্যোগপতি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে এক সূত্রে গাঁথতে সমর্থ হয়েছেন তাঁরা।
দুহাজার পনেরোর অগাস্ট মাসে শুরু হয়ে তিন পর্বের বিস্তর ঝাড়াই বাছাই। মাপকাঠিও কঠিন ছিল। কোনও সামাজিক প্রকল্পই তিন বছরের পুরনো হলে চলবে না। আর তাদের প্রকল্পের বিস্তারিত পরিকল্পনা সহ পুরো রিপোর্ট বিচারকদের মনে ধরলেই পাওয়া যাবে ফাইনালের ছাড়পত্র। এভাবেই দেশের সামাজিক ক্ষেত্রের ছশ প্রতিযোগীর থেকে সেরা দশটি মৌলিক উদ্যোগপতিকে বাছেন তাঁরা।
ফিন্যালের দিন আই আই আই এম কলকাতার মূল অডিটোরিয়ামে হাজির ছিলেন সেই সেরা দশ । অনুষ্ঠানে সেরার শিরোপা ছিনিয়ে নিলেন কানপুরের ছেলে অঙ্কিত অগরওয়ালের সামাজিক সংস্থা ‘হেল্প আস গ্রিন’।
কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি মিলল আড়াই লাখ টাকার আর্থিক পুরস্কার। কানপুরের মন্দিরগুলির থেকে পূজার ফুল সংগ্রহ করে তা থেকে জৈব সার, সুগন্ধি,ধূপ-কাঠি বানাচ্ছে রোহিতেরে সংস্থা। এর ফলে এখন আর ওই অঞ্চলের মন্দিরের পুজোর ফুল নদীতে গিয়ে মিশছে না। ফলে কমেছে জলদূষণ। এছাড়াও সাবান, সুগন্ধী ও জৈব সারা তৈরির কাজে কর্মসংস্থানও হয়েছে আশি জনের।
দেশের প্রত্যন্ত বিদ্যুতহীন অঞ্চলে সকলের ক্রয়ক্ষমতার মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে কাজ করছে জেভত্রেনিক্স। সামাজিক উদ্যোগপতি পুনের আশিস গাওয়াডের সংস্থা তার অভিনব চিন্তাভাবনার জন্য প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট রানার আপ। তাঁদের তৈরি যন্ত্রের মাধ্যমে কঠিন সময়ে হার্ট পেশেন্টদের প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। আর তাদের যন্ত্র চালাতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ যন্ত্রের ভিতরের পাওয়ার জেনারেটরই যোগাবে। ফলে কঠিন সময়ে পরি-কাঠামোর অভাবে আর ভুগতে হবে না রোগীর পরিবারকে। বাঁচবে অজস্র অমূল্য প্রাণ ।
যুগ্মভাবে সেকেন্ড রানার আপের সন্মান ভাগাভাগি করে নিলো বেঙ্গালুরুর হাসিরু ডালা ইনোভেশন ও বস্টনের ডিসিস ডায়াগনোসিস গ্রুপ। বেঙ্গালুরুর দশহাজার পরিবারকে নিয়ে কাজ করছে হাসিরু ডালা ইনোভেশন। সেখানকার ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টকে আমূল বদলে দেওয়ার স্বপ্নে কাজ করছেন তারা। ইতিমধ্যেই তাদের হাত ধরে কাজের ধারায় উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে। বদলে গেছে সেখানকার কাগজকুড়ুনি বা সাফাই কর্মীদের কাজের ধরণ। সেই সাফল্যেরই স্বীকৃতি মিলল আই আই এম এর ক্যাম্পাসে। টাটা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ চ্যালেঞ্জ এর মঞ্চে।
বস্টনের সংস্হা ডিসিস ডায়াগনোসিস গ্রুপ এর তৈরী যন্ত্রের পোষাকি নাম Rapid Assessment device বা RAM এর সাহায্যে সহজেই ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে যাবে । ম্যালেরিয়া আক্রান্তের রক্তের লোহিত কণিকার ম্যাগনেটিক চরিত্র বিশ্লেষণ করে সহজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ফলে চটজলতি চিকিৎসা শুরু হলে বাঁচবে রোগীর প্রাণ ।
জয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে টাটা মেডিকেল সেন্টার কলকাতার ডিরেক্টর ,ডক্টর সামেন চান্ডি বলেন, “বর্তমান প্রজন্মের ম্যানেজমেন্ট ছাত্রদের উচিত ব্যাক্তিগত জাগতিক তৃপ্তির চাইতে সামাজিক উদ্যোগের মধ্যেই পূর্ণতার অনুসন্ধান করা। “তার সেই কথার সমর্থন মিলল অডিটোরিয়ামে হাজির ম্যানেজমেন্ট ছাত্র ছাত্রীদের গলায় । একমত হলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নিজের উদ্যোগের কাহিনি আগামী প্রজন্মকে শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে আসা প্রতিষ্ঠিত সামাজিক উদ্যোগপতিরাও। শীতের সন্ধ্যায় আই আই এম কলকাতা সাক্ষী থাকল আগামী প্রজন্মের সামাজিক উদ্যোগপতিদের এই নতুন শপথের।