স্টার্টআপ তলিয়ে যেতে পারে, আপনি নন

স্টার্টআপ তলিয়ে যেতে পারে, আপনি নন

Friday October 09, 2015,

5 min Read

আইআইটি বম্বেতে পড়ার সময় একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলাম। সেটাকে স্টার্টআপ বলা উচিত হবে কি না জানি না। তবে সেটা দাঁড়িয়ে যাওয়ার মুখেই উঠে গিয়েছিল। আর্থিকভাবে আমরা লাভবান হয়েছিলাম, অনেক অভিজ্ঞতাও লাভ করেছিলাম, কিন্তু আট মাসের বেশি সেটা টিকল না। কী ছিল সেই ব্যবসা? পড়াশোনাকে আরও আনন্দদায়ক করতে কিছু অভিনব প্রজেক্ট এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে শর্ট কোর্স। এটাই ছিল পরিকল্পনা বা আইডিয়া। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা ব্যবসা গড়ে তোলা যা আমার অন্য উদ্যোগগুলিকে সহায়তা করবে এবং আমিও ভালোভাবে জীবনটা কাটাতে পারব।

image


MISTAKE 1: যে পরিকল্পনা বা আইডিয়ায় নিজের ১০০ শতাংশ দিতে পারছ না, সেই ব্যবসা না করাই ভালো। একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে গেলে সময় দিতে হয়, নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। সেটা না পারলে ব্যবসা কখনই দাঁড়াবে না।

ডিসেম্বর, ২০১৩

আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ছি। আইআইটি বম্বেতে একটা বিজনেস প্ল্যান কম্পিটিশন চলছিল। সেই 'ইউরেকা' প্রতিযোগিতায় আমি সেমিফাইনালে পৌঁছে যাই। সেখানে একটা সেশন ছিল যেখানে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করান হল। নতুন একটা ভেঞ্চার শুরুর জন্য সেখানেই আমাকে ২০ লক্ষ টাকার সিড মানি অফার করা হল। কিন্তু প্রযুক্তি নির্ভর সেই ব্যবসার ব্যাপারে আমি খানিকটা দ্বিধায় ছিলাম। সেই সময় আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটল একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভের। আগে তিনি একটি মিডিয়া হাউসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দেন। সেই ভদ্রলোক আমার নতুন উদ্যোগে পার্টনার হতে চাইলেন।শুধু পার্টনার হওয়াই নয়, প্রজেক্টের জন্য সিড মানি ও পূর্ণ সময় দিতেও রাজি হলেন তিনি।

MISTAKE 2: প্রযুক্তির ওপর জোর না দিয়ে সাধারণ উপায়ে (offline solution) কাজ করার চেষ্টা। এটাও একটা ত্রুটি। সময় বিশেষে অফলাইন ভালো, কিন্তু যতটা সম্ভব চেষ্টা করুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে।

MISTAKE 3: ব্যবসার খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিচক্ষণ এমন কাউকে মেন্টর বা পরামর্শদাতা বা লগ্নিকারী হিসাবে না পাওয়া। আমার বড় হয়ে ওঠা গুজ্জু-মারোয়াড়ি ব্যবসায়িক ধারায়। ফলে ফান্ড জোগাড়ের আমি পক্ষপাতী ছিলাম না। কিন্তু উদ্যোগ ব্যাপারটা খুবই কঠিন একটা কাজ। দৈনন্দিন কাজে এত সময় দিতে হয় যে বড় কোনও সুযোগ এলেও তা হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ঠিক তখনই একজন মেন্টর কাজে দেন।

MISTAKE 4: ব্যবসাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর সময় না দিয়ে শুরু থেকেই লাভের পিছনে দৌঁড়ন। এটাও একটা ত্রুটি। আমরা প্রথম দিন থেকেই লাভের কড়ি ঘরে তুলতে চেয়েছিলাম। ব্যবসাটা যাতে দাঁড়িয়ে যেতে পারে সেজন্য আমরা সময়, অর্থ, প্রচেষ্টা কোনও কিছুই দিতে রাজি ছিলাম না। আসলে বিজনেস কোনও পার্ট টাইম জব বা ফ্রিল্যান্স ওয়ার্ক হতে পারে না।

জানুয়ারি, ২০১৪

ব্যবসা শুরু করতে গেলে রেজিস্ট্রি করতে হয়। আমরা সেই কাজ শুরু করলাম। সমস্যার সূত্রপাতের যেন সেই শুরু। ব্যবসার ব্যাপারে আমাদের কর্মপদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গী দুই আলাদা। কোনও সমস্যার সমাধানে আমাদের যে উদ্যোগ তাতেও মিল ছিল না।

MISTAKE 5: কার কী দায়িত্ব সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনও লিখিত বোঝাপড়া না থাকা। কো-ফাউন্ডার বা সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে পৃথক বিষয়ে দক্ষতা থাকলেই ভালো। আর দায়িত্বের ব্যাপারটাও লিখিত হওয়া উচিত।

MISTAKE 6: নিজের ওপরে যথেষ্ট বিশ্বাস না রাখা। পরে এই ব্যাপারটা আমি উপলব্ধি করেছিলাম। সেজন্যই অভিজ্ঞতা জিনিসটা এত দামি। জীবন হোক বা ব্যবসা, ঝুঁকি থাকলেও শেষপর্যন্ত যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।

MISTAKE 7: টিম বা দল তৈরি না করে আমরা ফ্রিল্যান্সারদের ওপর ভরসা করেছি। সম্ভবত এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।

এপ্রিল, ২০১৪

শেষপর্যন্ত আমাদের প্রোডাক্ট তৈরি হল। এবার বিক্রির সময়। সমস্যার পাহাড় যেন আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। একে তো এন্ড-সেমেস্টারের পরীক্ষা, তার ওপর সেলস মিটিংয়ে যোগ না দিলেই নয়। সে যাই হোক,প্রতিদিন তিন ঘণ্টা ঘুরে-ঘুরে সম্ভাব্য কাস্টমারদের কাছে পৌঁছে আমাদের কনসেপ্ট বিক্রি করার চেষ্টা করতে লাগলাম। প্রথম মাসেই ১০ লাখ টাকার বেশি কোর্স বিক্রি হল। ঠিক এই জায়গাতেই ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য আমাদের টাকার প্রয়োজন হতে শুরু করল।

MISTAKE 8: লোককে বিশ্বাস কর, কিন্তু আইনি কাগজপত্র যেন ঠিকঠাক থাকে।

জুন, ২০১৪

এই মাসে ব্যবসা ভালোই হল। গত দু'মাসে ৫০ জনেরও বেশি ছাত্র আমাদের কোর্সে নাম লিখিয়েছে। আমাদের প্রথম সেন্টারে জায়গাও যেন কম পড়ছে। কাছেপিঠেই আমরা তখন দ্বিতীয় সেন্টার খুললাম। তখন আমাদের কর্মচারী পাঁচজন।

জুলাই, ২০১৪

আমাদের অর্থাৎ কো-ফাউন্ডারদের মধ্যে মতপার্থক্য এত মাথাচাড়া দিতে শুরু করল যে আর একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা তাই ব্যবসা তুলে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। একজন থার্ড পার্টির কাছে অর্থ ও রয়্যালটির চুক্তিতে ব্যবসা বিক্রিও হয়ে গেল। কাউকে পার্টনার করে বিজনেস করা মানে জানবেন, অনেকটা বিয়ের মতোই ব্যাপার। পরিস্থিতি যাই হোক, পরস্পর পাশে থাকা। তাই আপনাদের বলব, পার্টনার ঠিক করার সময় সতর্ক থাকুন। একবার পার্টনার ঠিক করে ফেলতে পারলে, পরিস্থিতি যেমনই হোক তার সঙ্গেই লড়ে যান।

কিছু অমূল্য শিক্ষালাভ

প্রথমবার ব্যবসা করতে নেমে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু কলেজের কোর্স যা শেখাতে পারে না, এমনই কিছু শিক্ষা লাভ করেছিলাম। অমূল্য সেইসব লেশন তুলে ধরলাম --

  • আপনি যা করতে চাইছেন তা শুরু করে দিন। বাকি কাজও দেখবেন ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
  • শুধুমাত্র টাকা বা ক্ষণস্থায়ী লাভের জন্য কিছু করবেন না।
  • বিরাট বড় ব্যবসা গড়ে তোলার ইচ্ছা না থাকলে স্টার্টআপে যাবেন না।
  • অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয় ভালো বিক্রিবাটা। ভালো সেলসম্যান হতে শিখুন।
  • ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে ব্যবসা হয় না, খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজের টিম তৈরি করুন।
  • প্রতি সপ্তাহে দেখবেন স্টার্টআপে কোনও না কোনও সমস্যা। মাথা ঠান্ডা রাখুন।
  • কঠোর পরিশ্রমের জন্য তৈরি থাকুন।
  • হৃদয় দিয়ে অনুভব করার শক্তির ওপর জোর দিন।

শেষকথা - ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী উদ্যোগে নেমে পড়েছি। নামটা বলে রাখিছ Medd.

(এই কাহিনির লেখক অর্পিত কোঠারি নিজে একজন উদ্যোগপতি। মেড সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। বম্বে আইআইটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর জবানিতেই তুলে ধরা হল তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। )