ভারত আর বাংলাদেশ। পাশাপাশি দুটি স্বাধীন স্বার্বভৌম্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভাবনায় সংস্কৃতিতে দুটি দেশের বিস্তর মিল। ইতিহাসের নাড়ি ছেঁড়া দুটো আলাদা স্বত্ত্বা। অথচ সৃষ্টিলগ্ন থেকেই দুই দেশ অমোঘ এক টানে সব সময় জুড়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সীমান্তের দুপারেই সমান ভাবে মর্যাদার নাম। রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি, কাজি নজরুল, কবি জসিমুদ্দিন, জীবনানন্দকে কোনও কাঁটাতার সীমায়িত বলয়িত করতে পারেনি। মানুষের হৃদয়েও কোনও বিভাজিকা রেখা আঁকতে পারেনি কোনও কুটিল কূটনীতি। কখনও থামিয়ে দিতে পারেনি দুদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনকে। শুধু সংস্কৃতি কেন, শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও দুই দেশ একে অপরের পরিপূরক। একদিকে বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্যে ভারতের ওপর বেশ খানিকটা নির্ভরশীল। আবার অনেক জিনিসের জন্য বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ভারতকেও। বাংলাদেশী ইলিশ থেকে রেডিমেড গার্মেন্টস বা শাড়ি নিয়ে তালিকাটা মোটের উপর বেশ অনেকটাই দীর্ঘ।
তাই বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের শিল্পসামগ্রী নিয়ে প্রায়ই ভারতে আসেন। ভারতের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল হামেশাই যায় বাংলাদেশ। কিন্তু দুদেশের মাঝের এই কাঁটাতার টপকাতে কত ঝক্কি পোহাতে হয় আমাদের অনেকেরই জানা নেই।আপাত সরকারি অথচ নিতান্তই বেআইনি হাজার একটা হার্ডেলের কথাই আমাদের জানালেন আন্তর্জাতিক শিল্পমেলায় বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা।
তাঁরা বললেন একদিকে যেমন আমদানি রপ্তানির সম্পর্কের উপর নির্ভরশীলতা দিন দিন বেড়েছে তেমনি সমস্যা বাড়ছে সমানুপাতিক হারে। আজও এই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাণিজ্য মখমল মসৃণ নয়। সীমান্তে কাস্টমস এর নিয়মের গেঁড়ো থেকে ভারতীয় ভিসার সমস্যা সবকিছু নিয়ে অনেক ঝক্কি। তাঁদের মধ্যে কিছুটা নিয়মের কাঠিন্য হলে আবার অনেকটাই নেহাত আমলাতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক জুলুমবাজিও বটে।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে আসা শাড়ি ব্যবসায়ী তপন কুমার দাস আমাদের কাছে উগরে দিলেন তার ক্ষোভ। বললেন,"আজ সাতান্ন বছর বয়স হল। দীর্ঘদিন ধরে ইন্ডিয়ায় জামদানী শাড়ির ব্যবসা করছি। কিন্তু পরিস্থিতির কোন বদল চোখে পড়ল না। আগেও যে ছবি দেখতাম এখনও পরিস্থিতি একই রয়ে গেছে। বরং দিনকেদিন আরও জটিল হয়েছে অবস্থা। প্রতিবছর এদেশে বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করতে আসি। সব রকম বৈধ কাগজ দিয়েই ব্যবসা করি। কিন্তু এবারও ট্রেড ফেয়ারে আসার সময় সীমান্তে একই অভিজ্ঞতা হল। বর্ডার পারের সময় কাস্টমস এর লোকের আবদার কিছু গিফট দিয়ে যান। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা করি। দু-পয়সা লাভের আসায় এদেশে আসি। আমার কাছে যেসব শাড়ি থাকে তার এক-একটার দাম ৩-৪ হাজার টাকার কম নয়। এত দামী শাড়ি যদি বর্ডার পারের আগেই দু-তিনটে কাস্টমস এর হাতে তুলে দিতে হয়, কেমন লাগে! হিলি, ঘোজাডাঙ্গা বা বেনাপোল যেখান দিয়েই ইন্ডিয়ায় ঢুকুন সব জায়গায় একই সমস্যা।"
একই কথা বললেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যবসায়ী। বললেন, কম্পিউটারের ব্যবহার বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সমস্যাও বেড়েছে তালমিলিয়ে। ভিসা পেতে ঘুষ যাতে না দিতে হয় তার জন্য নাকি ডিজিটাইজেশন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ভিসা অ্যাপ্লিকেশন করতেই আপনাকে ঘুষ দিতে হবে। দালাল ধরতে হবে। তারপর আছে কাগজপত্র নিয়ে নানা রকম হেনস্থা করার অভ্যেস। বড় ব্যবসায়ীরা সব রকম কাগজ দেখাতে পারেন। কিন্তু আমাদের মত ছোট ব্যবসায়ীদের সমস্যা অনেক। সাফটা (South Asian Free Trade Area) ডকুমেন্ট দেখাতে পারলে পণ্য শুল্কে বেশ কিছুটা ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারি দপ্তর থেকে সাফটা পেতে হলে আরও একগাদা অবাঞ্ছিত সমস্যা অপেক্ষা করছে।প্রচুর ডকুমেন্ট চায় অকারণে। এসব আর কিছুই নয় ব্যবসার পথ অমসৃণ করার ফিকির।
কাগজ দেখাতে না পারলে। কাগজ কেনার কুশ্রী প্রস্তাবও পেয়ে যাবেন কান পাতলেই। ঠিকঠাক টাকা খসাতে না পারলে ভারতে বাণিজ্য করতে আসার অন্যতম ডকুমেন্ট সাফটা অধরাই থেকে যাবে। বড় ব্যবসায়ীরা যে ছাড়ের সুবিধা পাবেন ছোটোরা সোজাপথে তা পাবেন না। ফারাকটা শুরুতেই তৈরি হয়ে যাবে। কাস্টমস ডিউটিতে গুচ্ছ টাকা বেড়িয়ে যাবে। তারপর মাল আনতে ট্রান্সপোর্টেশনে এপার ওপার দু'পারেই পোহাতে হবে চাঁদার জুলুম। উৎসবের মরসুমে সেই চাঁদার আবদার ছুতে চাইবে হিমালয়। বাধ্য হয়েই মালের দাম বাড়বে। ১০০ টাকার জিনিসের দাম ৫০০ টাকা হবে। আখেড়ে মার খাবে ব্যবসা। অস্বচ্ছ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আর যাই হোক সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা হয় না। তবে হ্যাঁ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে সরকারি সহায়তার জন্য অন্যান্য খরচ অনেক কম।তাতে কিছুটা হলেও সুরাহা হয়।
বাংলাদেশের বস্ত্র ব্যবসায়ীদের আরেক প্রতিনিধি ফারুক হুশেন বুলবুলের গলায় একই অভিযোগ। বললেন,"কিছু দিন হল ইন্ডিয়ান ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অদ্ভুত সমস্যা হচ্ছে। আগে যেমন নিজেরাই নেটে বসে বসে সহজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে যেতাম, এখন তা পাই না। লক্ষ্য করছি এজেন্ট না ধরলে সহজে সাধারণ লোকজন ভিসা ইন্টার্ভিউয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে গেলে দু-আড়াই হাজার টাকা এজেন্টকে দিতে হয়। তারপর আবার দূতাবাস যদি কোনও কারণে ভিসা অ্যাপ্লিকেশন বাতিল করে দেয় তাহলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। আবার টাকা খরচ কর। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাও। ব্যবসার জন্য আমায় নেপাল, ভুটানেও যেতে হয়। কিন্তু ওই দেশে ভিসার নিয়ম অনেক শিথিল। এত কড়াকড়ি তো নেইই বরং ব্যবসায়ীদের কি আদর করে ডাকে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনতাম ইন্ডিয়ান ভিসার নিয়ম পাল্টে যাবে। তখন আর এত ঝুট ঝামেলা পোহাতে হবে না। আপনাদের তো আমাদের দেশের ভিসা পেতে কোনও ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাহলে আমাদের বেলায় এত ঝামেলা কেন।"
এর উত্তর একমাত্র সরকারি আধিকারিকেরাই দিতে পারবেন। খালি একটাই প্রশ্ন যখন চারদিকে দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে এত ভালো ভালো আলোচনা চলে। আর দুদেশই যখন বাণিজ্যে বিভিন্ন শুল্ক থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা আয় করে। তখন ব্যবসায়ীদের অভাব অনুযোগগুলো একটু শুনবেন প্লিজ।