হাটখোলার আখড়ায় ১০৬ বছর ধরে চলছে মানুষ গড়ার কসরত
সুকুমার রায়ের পালোয়ান কিভাবে হাতি লোফে দেখতে চান। চলে আসুন হাটখোলায়। উত্তর কলকাতা ঐতিহ্যের এই এলাকায় এলেই টের পাবেন কাকে বলে পালোয়ানের ঠেক। আর কোথায় আছে হনুমান জীউর আস্তানা।

শোভাবাজারের হাটখোলা। উত্তর কলকাতার প্রাচীন এলাকাগুলোর মধ্যে এর নাম আসে বইকি। হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রীট ধরে নাক বরাবর এগোলে আপনি একটি সরু গলি পাবেন। দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। দুপাশের হোয়াইট ওয়াশ করা দেওয়াল থেকে উঁকি মারছেন স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা আর সপারিষদ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ। কথামৃতের ছবিতে ছয়লাপ। এসব দেখতে দেখতে আপনি মনে মনে পৌঁছে যাবেন শ’দুয়েক বছরের পুরনো ইতিহাসে। আর রাস্তাটা যেখানে গিয়ে ধাক্কা খাবে সেখানেই রয়েছে এই শহরের শতাব্দী প্রাচীন ব্যায়ামের আখড়া। হাটখোলা ব্যায়াম সমিতি। বয়স ১০৬ বছর। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জিমনাসিয়াম। আজও হাটখোলার এই পালোয়ানের আখড়া দেখলে কেউ বলবে না এর এত বয়স হয়ে গিয়েছে। সে যেন এর সদস্যদের মতই চির যৌবনের আশীর্বাদে ধন্য। ঐতিহ্যের আখড়া। হবে নাই বা কেন, মনোহর আইচের মতো আরও কত নামজাদা পালোয়ান এখানকার বিশাল হনুমান জীউর মূর্তির সামনে কুস্তি করতেন, মুগুর ভাজতেন।
হাটখোলার মিত্র পরিবারের স্থানীয় কিছু স্থাবর সম্পত্তি আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পুষ্পলাল চক্রবর্তী অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। মিত্র পরিবার এঁদের দুজনকে হাটখোলার এক চিলতে জমি দান করেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারিণ ঘোষ আর ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হন। সেসময় অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপের মধ্যে শরীরচর্চা আর ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত ছিল। মিত্রদের আনুকূল্যে এই সমিতি সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে দল গড়ে তোলে।
পুরনো আমলের কাঠের দণ্ড, লোহার ওয়ালবার, ক্লাসিক ডন বৈঠকের জন্য ডন-কাঠ, লেগ-প্রেস, বেঞ্চ-প্রেস আর পুলওভার সব আছে। পালোয়ান আর ব্যায়ামবীরেরা সেইসব যন্ত্রপাতি দিয়েই শরীরচর্চা করেন। নিয়মিত সদস্যরা আসেন মল্লচর্চা করতে। কুড়ি থেকে সত্তর। সব বয়সের সদস্য রয়েছে। মোট সদস্য সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার। চাঁদা মাত্র ৫০ টাকা।
সময়ের সাথে পাল্লা দিতে হাটখোলা ব্যায়াম সমিতি অত্যাধুনিক ওয়ার্কআউট সরঞ্জাম এনেছেন আখড়ায়। তবে যারা প্রকৃত কুস্তিগির তাঁরা প্রথাগত মল্লচর্চাই পছন্দ করেন। এই সমিতি বহু মল্লবীরের জন্মভূমি। শঙ্কর সাহা, কার্তিক সাহা, কালাচাঁদ রায়, আর সম্প্রতি ২০১৩-১৪ নাগাদ সুজন রায় এখানেই শরীরচর্চা করে মিস্টার ইন্ডিয়া হয়েছেন। এটাই তাঁদের কাছে মন্দির। প্রতিদিন দুঘণ্টা তাঁরা কঠোর শরীরচর্চা করেন। ছোলা বাদাম আর ব্যায়ামে বানানো শরীর। স্টেরয়েডে ফোলানো ছয় প্যাক আট প্যাক অ্যাবের হিড়িক নয়। প্রকৃত কসরত করে তিলে তিলে গড়ে তোলা ট্রাইসেপ বাইসেপ আর চওড়া ছাতির পেটানো চেহারা। সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দের আদর্শ শরীরের ভিতরের সত্তাকে তৈরি করে। শতবর্ষ পেরিয়েও তরতাজা থাকার এটাই রহস্য। আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে বদল করার মানসিকতাও তাজা রেখেছে এই প্রাচীন আখড়াটিকে। একবার পাড়লে আপনিও আসুন না দেখে যাবেন হাতি লোফার কায়দাটা।