কাস্ত্রো যেমন ছিলেন...
ফিদেল নেই। কিন্তু ফিদেল থাকবেন। কিউবার স্বৈরতন্ত্র নাকি প্রলেতারিয়তের শাসন, নাকি বিপ্লবই নিজেই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র তন্ত্রসাধনা। লিখছেন এই সময়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য গদ্যকার অর্ণব দত্ত।
সারাটা জীবন ফিদেল কাস্ত্রো সামরিক উর্দি পরে কাটিয়েছেন। একটা কথা মনে হয়, ইউনিফর্ম বস্তটি আদতে একপেশে ও একঘেয়ে নয় কি? যেমন ধরুন, স্কুল ইউনিফর্ম কি খুব ভালবাসার মতো পোশাক?
যে কোনও ইউনিফর্মই কোনও না কোনওভাবে আদতে সামরিক। এ দিকে ওটা গা থেকে খুলে ফেললেই ইউনিফর্মের ধারককে হয়তো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়তে হতে পারে! সামরিক ব্যাপারটাই তো একচোখোমি।
ফিদেল কাস্ত্রোর কোনও আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ছিল কিনা জানি না। তবে দীর্ঘ কয়েক দশক যে তিনি সামরিক উর্দি ছেড়ে সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক পোশাক পরেননি, সে তো দিনের আলোর মতো অথবা রাত্রির অন্ধকারের মতো এই দুনিয়া খালি চোখে স্পষ্ট দেখেছে।
শাসন ক্ষমতা জিনিসটি আসলে অভিশাপের মতো কালো। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে এর অজস্র সাক্ষী আছে। বিশেষত, বিপ্লবাত্মক প্রয়াসের ভিতর দিয়ে যে সমস্ত মানুষ ক্ষমতার মসনদে আসীন হন, তাঁরা যেন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে কেমন বেঁকে বসেন।
অনেক সময় ব্যাপারটা শেষমেশ জনবিরোধী কার্যকলাপেও রূপান্তরিত হয। বিপ্লবী নায়ক স্বৈরাচারিতার দায়ে অভিযুক্ত হন। কমিউনিস্ট দুনিয়ায় বা সাম্যবাদী দেশে কমরেড স্তালিন থেকে শুরু করে সদ্যপ্রয়াত ফিডেল কান্ত্রোর বিরুদ্ধে বরাবরের জন্যে সেঁটে গিয়েছে মানবতা বিরোধী তকমাও। স্তালিনের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন, প্রতিহিংসাপরায়ণতার অভিযোগ রীতিমতো উচ্চকিত। স্তালিনের মেয়ে নিজেই তাঁর বাবার কর্মকাণ্ডের বিরোধী।
বিপ্লবী নায়করা যে কেন পরে অনেক সময়ই আপাদমস্তক পাল্টে যান, এটা বলা মুশকিল। তা হলে কবর থেকে তুলে এনে তাঁদের মাথার খুলি পরীক্ষা করা দরকার। পৃথিবীতে এমন বিতর্কিত মানুষের মাথার খুলি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তো অতীতে হযেছে। যৌনচারে জীবনভর স্বেচ্ছাচারিতা করে আসা মাক্যুইজ দ্য সাদের মুণ্ডু নিযে এমন পরীক্ষার কথা জানা যায়। অথচ, তিনি আধুনিক পৃথিবীতে মদনদেব হিসাবে আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের কাছে শিরোপা পেয়েছেন। সত্যিই, ইতিহাসের চেয়ে মহান বিচারক আর কেউ নেই!
ফিদেল কাস্ত্রো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সমাজ, মানুষই তাঁর শ্রেষ্ঠ বিচারক। ফিদেল প্রথম জীবনে কিউবার ভয়ানক অত্যাচারী শাসক ফুনহেনসিও বাতিস্তার বিরুদ্ধে অসমসাহসে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্রোহের নামান্তরে অশেষ ক্লেশ সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। প্রাণ বাজি রেখে হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু স্লোগান দিয়ে ফিদেল যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, ওই সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছিলেন।
এরপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে শক্তহাতে কিউবা শাসন করেছেন। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্যে হাজার হাজার সেনা প্রেরণ, বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা নেলসন ন্যান্ডেলার হাত শক্ত করা - আসলে তালিকা প্রলম্বিত না করেই বলা যায়, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় মানবতাবাদের পক্ষে ফিদেলের লড়াইয়ের বেশ কিছু নজির থেকে যাবে।
তবু কলঙ্কিত ফি্দেল কাস্ত্রোও। নাকি কলঙ্ক সাগরে ভাসি কলঙ্ক না লাগে গায়? নাহ, এমনটি হওয়ার জো নেই। পরকালের ম্যাজিক্যাল নিয়মকানুন ইহকালে অচল আধুলির মতো। কাস্ত্রোর জন্যে এক সময়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন যাঁরা, সেই সমস্ত মানুষের পরিবারবর্গ ফিডেলের প্রয়াণের খবরে মায়ামির রাস্তায় ঢাকঢোল পিটিয়ে সানন্দে ঘোষণা করছেন, ওঁর মতো একটা আপদ দুনিয়া থেকে বিদেয় হয়েছে। বাঁচোয়া আর কী!
আসলে বিপ্লবী মানসিকতায় একরোখোমি থাকে। না হলে ফিদেল ওই কথাটা বলতেই পারতেন না, হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু। আমাদের দেশের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী যেমন একদা জীবনপণ করে বলেছিলেন, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে, ফিদেলও তেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। নেতা হিসাবে ফিদেল উদ্বুদ্ধ করেছিলেন কিউবার লাখো লাখো সংগ্রামী জনসাধারণকেও।
নিজের মতে করে চলতে ভালবাসতেন ফিদেল। বিপ্লবটাও করেছিলেন স্বাধীনভাবে, পুরনো তত্ত্বের রেযাত না করে। সবাই জানেন, এ কারণে রাশিয়া বা চিনের কাছে নিছক রোমান্টিক একজন বিপ্লবী নায়ক ছিলেন ফিদেল। ভারতের কমিউনিস্টরাও কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোকে একজন অ্যাডভে়ঞ্চার প্রিয় বিপ্লবী হিসাবে মনে করতেন। কমিউনিস্ট শিবিরের কাছে তাঁর বিপ্লবপন্থা সে্ অর্থে স্বীকৃতি পায়নি। যদিও কিউবার মানুষের তাতে কিছু আসে-যায়নি। স্বদেশের মানুষের কাছে তিনি এখনও একজন বিপ্লবী নায়ক।
কিন্ত একটা প্রশ্ন খচখচ করছে যেন! সেটা হল, ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বিপ্লবী নায়কদের হাতে যখন রাজদণ্ড তুলে দেয়, সে ক্ষেত্রে তাঁরা নিজের পূর্ব অবস্থান থেকে ক্রমশই যেন অনেক দূরে সরে যান, ইতিহাসে বারেবারেই এমনটা দেখা গিয়েছে। ফিডেলের গায়েও লেগেছে এই অভিশাপ। এ নিয়ে বোধহয় আজীবন কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে ফিদেলকে।
কেননা রাজদণ্ড ঘোরানোর অধিকার বিপ্লবীর করায়ত্ত হলে পূর্বতন কমরেডরাই কখনও মতবিরোধ অথবা স্বাধীন মত ব্যক্ত করার জেরে পূর্বতন বিপ্লবী অধুনা শাসকের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।
কথায় বলে, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ফিদেলের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় তাই-ই। সংগ্রামের সহচর, বিশ্ব সাহিত্যের দিকপাল কয়েক জন স্বদেশীয় সাহিত্যিক – হেবার্তো পাদিল্লা, রেইনালদো আরেনাস ও ভার্জিলিও পিনেরার মতো কয়েকজন সত্তর দশকের গোড়ায় ফিডেল বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাবাস ভোগ করেন। সে সব অভিজ্ঞতা পরে সাহিত্যের পাতাতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
শিল্পীরা আসলে সত্যকে সর্বাঙ্গসুন্দর হিসাবে দেখতে চান। সে হিসাবে একজন সংগ্রামী শিল্পী সর্বাঙ্গসুন্দর মানব সমাজ কিংবা স্বদেশের স্বপ্ন তো দেখবেনই। এই স্বপ্নটাই শিল্পীকে এতই তাড়িত করে থাকে, যে কারণে শেষপর্যন্ত তাঁর পক্ষে বংশবদভাবে কোনও ব্যবস্থাকে সমর্থণ করে ওঠা আদৌ সম্ভব হয় না।
আসলে একজন সংগ্রামী শিল্পী এমন কোনও শক্তির পক্ষে ওকালতি করবেন না, যে ক্ষেত্রে ক্ষীণতম বিবেক দংশনের সম্ভাবনা আছে। এ কারণেই পাদিল্লা, আরেনাস বা পিনেরার মতো শিল্পী বরণ্য সাহিত্যিকদের ফিদেলের চক্ষুশূল হতে হয়েছিল। আদতে ফিডেলের আমলের দমবন্ধ করা অমানবিকতার বিরুদ্ধে শিল্প করেছিলেন তাঁরা।
(Disclaimer: The views and opinions expressed in this article are those of the author and do not necessarily reflect the views of YourStory)