এইডস মুক্ত দুনিয়া দেখতে সাইকেলে ১১৪ দেশ

এইডস মুক্ত দুনিয়া দেখতে সাইকেলে ১১৪ দেশ

Wednesday December 23, 2015,

4 min Read

সাইকেলে চেপে কত দুর গিয়েছেন? বড়জোর এক বা দু ঘন্টার পথ তাইত। কিন্তু সাইকেলে চেপে এগারো বছর ধরে বিশ্ব ভ্রমণ! এই আজব নেশাতেই মজেছেন সুন্দরবনের বাসন্তীর যুবক সোমেন দেবনাথ। ২০০৪-য় যাত্রা শুরু করে ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছেন ১১৪ টি দেশ। সাইকেলে চেপে পিছনে ফেলে এসেছেন প্রায় ১, ২৭, ০০০ কিলোমিটারেরও বেশী পথ।

image


সবকিছুর যেমন একটা শুরু থাকে। সোমেনর এই বিশ্ব ভ্রমণের একটা শুরু ছিল।তার বয়স যখন মাত্র চোদ্দ বছর,তখন এইডসের ভয়াবহতা নিয়ে খবরের কাগজে একটি আর্টিকেল পড়েন। জানতে পারেন ভবিষতে এই রোগ ক্যান্সারের চাইতেও ভয়াবহ আকার নেবে। কিন্তু কলকাতা থেকে বহু দূরে বাসন্তীতে বসে অনুভব করলেন এই রোগ সন্মন্ধে সচেতনতার অভাব। আর্টিকেলে লেখা কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনের বাড়ি থেকে তাড়িত, সহায়সম্বলহীন এইডস রোগীর জীবন ছুঁয়ে গেছিল সোমেনকে। শপথ নেন এইডস বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার।প্রস্তুতি শুরু হয়। বছর খানেকের মধ্যে রাজ্যে সরকারের এইডস ট্রেনিং সংস্থা, ওয়েস্ট বেঙ্গল সোসাইটি ফর এইডস কন্ট্রোল থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর নিজের স্কুলে এই রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পেইনিং শুরু করেন। এরপর বাসন্তীতে নিজের গ্রামের মানুষকে এইডস নিয়ে শিক্ষিত করে তোলেন। এরপর স্কুল শেষ করে কলেজ সেখানেও চলে একই কাজ।

কলেজে জুওলজি আর পাশাপাশি ফাইন আর্টসের ডিগ্রি শেষে তিন মাসের প্রস্তুতি। তারপর ২০০৪ সালের ২৭ মে বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন ওয়ার্ল্ড ট্যুরে। প্রথম দু'বছর ঘুরলেন গোটা ভারত। দেখা করলেন ২৫ টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও ২৬ জন গভর্নরের সঙ্গে। ভারতে প্রত্যন্ত প্রান্তেও গড়িয়েছে তার সাইকেলের চাকা। তারপর ভারত ভ্রমণ শেষ করে বেড়িয়ে পড়লেন বাকি দুনিয়া দেখতে। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে তাকে ফ্ল্যাগ অফ করলেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মূখার্জি।

পাকিস্তান পেরিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকতেই বিপত্তি। কাবুল শহরের অদূরে তালিবানদের হাতে আটক হলেন। প্রথম ক'দিন অন্ধকার ঘরে। চলল অকথ্য অত্যাচার। সুদূর ঘানা থেকে টেলিফোনে আমাদের জানালেন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা, "চার দিন নাখাইয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। শুধু মারধর করত তালিবানরা। তবে আমি একদিনও হতাশ হয়নি,জেদ ছিল হার মানব না।বিশ্ব ভ্রমণের যে স্বপ্ন চোখে নিয়ে বাসন্তী ছেড়েছিলাম তা বাস্তব করতে হবে যে। সব অত্যাচার সহ্য করছিলাম। ধীরে ধীরে ওরা বুঝল আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্যে নেই। তখন আমাকে কুকের কাজে লাগালো। এগারো দিন ওদের রান্নার কাজ করলাম। আমার হাতের সুন্দরবনের রান্না খেয়ে মন গলল কাবুলি তালিবানদের। তারপর চব্বিশ দিনের বন্দিদশা কাটল।" এই চব্বিশ দিনের ৪ দিন না খেয়ে,৯ দিন তালিবানদের সাফাই এর কাজ করে,আর ১১ দিন রাঁধুনির কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন সোমেন।

গত এগারো বছরে এইডস এর বিষয়ে সচেতনতা ছড়াতে পাড়ি দিয়েছেন একশোরও বেশী দেশ। ডাকাতের হাতে নিঃস্ব হওয়ার মত খারাপ অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে। তেমনি ভাল অভিজ্ঞতাও রয়েছে প্রচুর। স্বাচ্ছন্দ্য, প্রাচুর্যের মাঝে দিন কাটানোর পাশাপাশি আফ্রিকায় খোলা আকাশের নীচে আদিবাসীদের সঙ্গে চিতা, গন্ডারের গায়ে গা লাগিয়ে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ২০১১ সালে উত্তর মেরুতে যাত্রার সময় -৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে জমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। উত্তর মেরুতে এস্কিমোদের সঙ্গে দিন কাটানোর স্মৃতি তার কাছে আজও অন্যতম সেরা অনুভূতি।বিবেকানন্দের ভারত এর বানী পাথেয় করে পথে নেমেছেন সোমেন। তিনি বলেছিলেন গোটা বিশ্বজুড়ে খণ্ড,খণ্ড ভারতবর্ষ ছড়িয়ে রয়েছে। আর এই ভারতবর্ষকে খুঁজতেই যেন পথে নামা। 

ইউরোপ হোক বা মধ্যপ্রাচ্য অথবা আফ্রিকা ভারতীয় ভাই বোনেরা ঠিক খুঁজে পেতে আপন করে নিয়েছেন সোমেনকে। সফরকালে আজ অবধি ২৬ টি দেশের প্রেসিডেন্ট, ৫৬ টি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ১০৫ টি দেশে ভারতীয় হাই-কমিশনার বা অ্যাম্বাসেডর ও কয়েক লক্ষ মানুষকে ছুয়ে গেছেন।কিন্তু এত লোকের মাঝে আজও সোমেনের চোখে দেখা সবচাইতে সুখী মানুষ হলেন একজন বাংলাদেশী। যিনি মাত্র ২৫ টাকা দৈনিক রোজগারেও নিজের পরিবারকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটান।যেখানেই গেছেন সেখনকার স্কুল,বিশ্ববিদ্যালয়,এনজিও রেস্টুরেন্ট হোক বা ফ্যাক্টরি সবজায়গাতেই ওয়াকর্শপ করেছেন। মুগ্ধ হয়েছে সকলে। এইচ আই ভি, এইডস এর পাশাপাশি ভারতীয় সংস্কৃতির উপরও সেমিনার কনফারেন্স করেন সোমেন। কোনও রকম স্পনশরশিপ ছাড়া শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত উদ্যোগেই এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু চান শেষের পাঁচ বছরে অর্থের কারণে যাতে তার যাত্রা ব্যহত না হয়। যেখানেই গেছেন স্বানীয় মানুষ ও ভারতীয়রা তার এই জার্নিতে উদ্ধুদ্ধ হয়েছেন। আর সবদেশেই এক টুকরো ভারতের সাক্ষী থেকেছেন তিনি।

কিন্তু সবকিছু ছেড়ে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ কেন? সোমেনের মতে,'এর চারটে কারণ ছিল। 

  1. আমার কোন স্পনসর ছিল না। 
  2. সাইকেল হচ্ছে মানুষের কাছে পৌছবার সবচাইতে সেরা মাধ্যম। 
  3. এটা কোনও পরিবেশ দূষণ করে না। 
  4. ফিট থাকবার জন্য সাইক্লিং এর কোন বিকল্প নেই।তবে সাইকেলে ঘূরতেও খরচ আছে।কোন স্পনসরশিপ ছাড়া শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সাহায্যে এতদুর এসেছি।লোকজনের সাহায্য ছাড়া এইযাত্রা সম্ভব হত না।"
image


এইডস মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন সোমেন। তার জন্য সচেতনতা বাড়াতে ২০২০ সালের মধ্যে ১৯১ টি দেশ অতিক্রম করে ২,০০,০০০ কিলোমিটার সাইকেল পাড়ি

দেবেন তিনি। ইচ্ছে পথে দুকোটি লোককে তার এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ছুঁয়ে যাওয়া। সেই স্বপ্নের পিছনে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলেছেন একা। আপনি যখন শীতের দিনে বা রাতে আপনার ল্যাপটপে বা ফোনে এই লেখা পড়ছেন। তখন সাইকেল প্যাডেল করে সোমেন এগিয়ে চলেছেন আফ্রিকার কোন একটি অচেনা দেশ থেকে আর একটি অচেনা দেশে। যদি চান সোমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ওর ইমেল ঠিকানা [email protected] আমাদের দিয়েছেন সোমেন। চাইলে বাক্যলাপ করতেই পারেন। কেননা তার কাছে মিলনই জীবন আর চলাই একমাত্র দর্শন।