পিলুর পাঠশালায় বাংলা ভাষা শিখছে মুম্বই

পিলুর পাঠশালায় বাংলা ভাষা শিখছে মুম্বই

Sunday February 21, 2016,

3 min Read

লাখ তের বাঙালি থাকেন মুম্বইয়ে। গাঙ্গেয় পলি মাখা নিরাপদ চাষের জমি ছেড়ে ওঁরা দেশের অর্থনৈতিক রাজধানিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন শুধুমাত্র কাজের সূত্রে। আসার সময় হয়ত বাক্স পেট্রায়, জামায় কাপড়ে মুড়ে ঠাকুরের ছবি, পীর বাবার মাদুলি, মায়ের দেওয়া আঁচার, ঘন সরষে দেওয়া কাসুন্দি, শুকনো আমসত্ত্ব, গয়না বড়ি, গুড় দিয়ে নারকেলের নাড়ু এসব বেঁধে ছেদে নিয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ সঙ্গে এনেছিলেন বিভূতিভূষণ, আনন্দমঠ, গোরা। অধিকাংশের সঙ্গেই সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা আর গীতবিতানের হলুদ পাতা যত্নে এসেছিল 'বোম্বাই'। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে আমচি মুম্বই হওয়ার দৌড়ে বাংলার ভাষা ক্ষয়ে গেছে অনেকেরই। কথার ফাঁকে ফাঁকে মারাঠি শব্দ গুজে গেছে। মারাঠি বর্গীদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছে বাংলা।

image


কিন্তু শেকড়! সে এমন অদ্ভুৎ আঠালো বিষয়, ছাড়ালে না ছাড়ে... কাঠালের আঠার মত। অথবা তার থেকেও অনেক বেশি। রক্তের ভিতর গেঁথে যাওয়া এমন এক পরিচয় কেউ জানুক না জানুক আপনি জানেন আপনি কে। ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগুক না লাগুক শেকড়ের টানে তাই বাংলা চর্চার তাগিদ অনুভব করেন অনেকেই। মাতৃভাষা তো শুধু ভাষা নয় এমন চেতনা যা আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে যুক্ত।

এইসব সাত পাঁচ ভেবে মুম্বইয়ের মতো দুরন্ত কেজো শহরটাতেই এক বাঙালি শিল্পী এগিয়ে এলেন শিকড়ের সন্ধান দিতে। নাম পিলু। ভালো নাম রাজোসী বিদ্যার্থী। ছাত্র- এই অর্থে বিদ্যার্থী শব্দের ব্যবহার খুব পরিচিত। কিন্তু পদবী হিসেবে বিদ্যার্থী বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বলিউডের ডাক সাইটে খলনায়ক অসাধারণ অভিনেতা আশিস বিদ্যার্থীর মুখ। আজ্ঞে হ্যাঁ। পিলু আশিসের স্ত্রী। সেই অর্থে আশিস বাংলার জামাইবাবু। অভিনেত্রী শকুন্তলা বড়ুয়ার ঘরের জামাই। বিয়ের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পিলু টের পান শেকড়ের টান কাকে বলে। তাই স্বামীর সহযোগিতায় আরবসাগরের পারে খুলে ফেলেছেন বঙ্গোপসাগরের গান শেখানোর স্কুল। বাঙালিকে বাংলা শেখানোর পাঠশালা। বাংলা মানে শুধু বাংলা ভাষা নয়। বাংলার সংস্কৃতিও শেখান পিলু। তাঁর এই ইস্কুলের নাম দিয়েছেন ছুটির পাঠশালা। হযবরল, রবীন্দ্রসংগীত, পল্লীগীতি, কালোয়াতি নজরুল, ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে নাচ সবই চলে একাধারে।

কেন হঠাৎ ছুটির পাঠশালা? বলতে গিয়েই পিলু বললেন, বিয়ের পর মুম্বইয়ে এসে খুব সমস্যা হত। ভাষাটা জটিল লাগত। বাঙালি খুঁজতেন। দেখলেন এই শহরের সার্ভাইভাল প্যাকেজ হিসেবে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা মা তাঁদের সন্তানদের বাধ্য হয়েই বাঙলার বদলে হিন্দি কিংবা মারাঠি শেখান। আর ঠিক তখনই মনে মনে পিলু ঠিক করে ফেলেন নিজের ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেবেন না। যেমন ইচ্ছে তেমন কাজ। ছেলে আর্থ যখন একটু একটু করে বড় হতে শুরু করলেন শুনে শুনে ভাষা শেখার সময় থেকেই পিলু খুব সতর্ক ছিলেন বাংলাটা তাই ভালোই জানেন মালয়লি আশিসের ছেলে আর্থ। পিলু বলছিলেন ছেলেকে বাংলা সংস্কৃতি ভাষা শেখাতে শেখাতেই নিজের অজান্তেই গড়ে উঠেছে ছুটির পাঠশালা। ছুটির অবসরে একটু বাংলা নাচ-গান সংস্কৃতি চর্চা চলত বলেই হয়তো এমন নাম দেওয়া। রুল একটাই এই পাঠশালায় কথা বলতে হবে বাংলাতেই। 

তাই প্রেজেন্ট নয় বলতে হবে উপস্থিত। ম্যাডাম নয় দিদিমণি। স্পোকেন ইংলিশের মতোই স্পোকেন বাংলার জবর ক্লাস। এই দিদিমনির মুখে সবসময় হাসি লেগে রয়েছে। ২০০৬ সালে পিলু যখন শুরু করেন তখন ছাত্রসংখ্যা ছিল পাঁচ কি ছয়। সেবার মুম্বইয়ের কালীবাড়িতে প্রথম পারফরমেন্সে মুম্বইয়ের বাঙালিদের নজরে আসে ছুটির পাঠশালা আর পিলুর উদ্যেগ। সেই শুরু আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আজ ছাত্রসংখ্যা ৩৮। এখন জুহু থেকে বান্দ্রা, সরস্বতী পুজো থেকে দুর্গাপুজো সবেতেই ডাক পড়ে ছুটির পাঠশালার। এই ন-দশ বছরের উদ্যোগে মুম্বইয়ের ছেলেমেয়েরা নির্ভুল বাংলায় কথা বলতে শিখেছেন বাংলায় লেখা পড়তে পারেন অনেকেই। এসব দেখে পিলুর মুখে যেন চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙে যায়।