দেওয়ালে জীবন আঁকেন তমলুকের লক্ষ্মীকান্ত

দেওয়ালে জীবন আঁকেন তমলুকের লক্ষ্মীকান্ত

Thursday March 10, 2016,

3 min Read

নিজের ঘরে বসে যদি পিসার হেলানো মন্দির দেখা যেত, কিংবা আকাশের তারা গুলো যদি ছাদের আরও কিছুটা কাছাকাছি এসে যেত, তাহলে সেই অনুভূতিটা বোধহয় খুব একটা খারাপ না। অর্ডার করলে যেকোনও ভালো রং কোম্পানি নিশ্চয়ই সাজিয়ে দিতে পারে আপনার শোয়ার কিংবা বসার ঘর, কিন্তু আমি আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এমন একজন শিল্পীর যিনি শুধুমাত্র ভালবেসে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন নিজের মনের টানে। ছোটবেলা থেকেই অল্পবিস্তর ছবি আঁকতে পারতেন তমলুকের শালিকা ধনুচক গ্রামের ছেলে লক্ষ্মীকান্ত দলুই। বাবা বিমল দলুই পেশায় ব্যবসায়ী। ডেকরেটারের ব্যবসায় কোনমতে সংসার চলে যায় দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে তাই ছেলের পড়াশুনার খরচের সাথে আর আঁকা শেখানোর ক্ষমতা ছিলনা তাঁর। কিন্তু ছেলের ভালবাসার বিষয়কে পুরো অবহেলা করাও সম্ভব নয় তাই অনেকটা অনুঘটকের কাজ করতেন তিনি নিজেই। আসলে নিজের পেশার কারণে কিছুটা শিল্পবোধ ছিল বিমল বাবুরও। তাই ছেলের আঁকা ছবিতে বা শিল্প কর্মে অনেক সময় ফাইনাল আঁচর মারতেন তিনিই। 

image


লক্ষ্মীর বয়স তখন চোদ্দ কি পনের হবে। পাশের গ্রামের একটা পুজো মণ্ডপ সাজানোর ভার নেয় সে। আর প্রথম কাজেই বেশ সাফল্য মেলে তাঁর। নারকেলের ছোবড়া আর দড়ি দিয়ে তাঁর বানানো মণ্ডপ নজর কাড়ে অনেকেরই। সাথে নিজের আঁকা কিছু পোস্টার যেন মণ্ডপের মধ্যে একটা অন্যরকম ছোঁয়া এনে দিয়েছিল। আসতে আসতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে দলুই বাড়ির ছেলেটা। গ্রামের ছোট বাচ্চারা তাঁর কাছে আসতে শুরু করে ছবি আঁকা শিখতে। ইয়োর স্টোরির সাথে কথা বলার সময় বছর ছাব্বিশের ছেলেটা বলছিল “পয়সার অভাবে নিজে কখনো কোন আঁকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি, তাই সেভাবে কোন সার্টিফিকেট নেই তাঁর কিন্তু শিল্পবোধটা ছিল ছোটবেলা থেকেই। আর তাই তাঁর ছাত্র ছাত্রীরাও কোন প্রচলিত নিয়মের বাঁধনে বাঁধা পড়ে তাঁর কাছে আসেনা। মনের মতো করে মনের ইচ্ছাতেই সবাই ছবি আঁকে তাঁর কাছে”। 

আঁকা শেখানোর থেকে উপার্জিত পয়সা দিয়েই হলদিয়ার কলেজ থেকে আই.টি.আই পাশ করে লক্ষ্মী। কলেজে পড়ার সময়ও বিভিন্ন পূজা অনুষ্ঠানে মণ্ডপ সাজানোর কাজ করত সে। বলছিল যে শুধুই উপার্জনের জন্য নয়, নিজের শখের থেকেও অনেকসময় এইসব কাজ সে করত। বি.এড কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের পোস্টার বানানো থেকে শুরু করে, নিজের কলেজের বন্ধুদের প্র্যাকটিকাল খাতা বানানোর কাজ করত সে স্বল্প মূল্যে। এইভাবেই ক্রমশ উপার্জনের সাথে সাথে অভিজ্ঞতাও বাড়তে থাকে তাঁর। নতুন বিভিন্নরকম আইডিয়া মাথায় আসতে থাকে। এইসময়ই এক বন্ধুর সাহায্যে কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটের ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের কাজ পায় সে। ফ্ল্যাটের দেওয়ালে নিজের মনের ছবি এঁকে বেশ মন টানে ফ্ল্যাট মালিকের। সেই সূত্রেই পেয়ে যায় আরও কিছু কাজ। কিন্তু সংসারের অভাব আর নিজের জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য দরকার ছিল আরও বেশি উপার্জন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে শুরু করে সে। কিন্তু সেখানে চাকরি করতে গিয়ে সে বুঝতে পারল যে তাঁর নেশা বা ভালবাসাটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে সেখানে চাকরি করলে। প্রতিষ্ঠানের কাজের চাপে তাঁর ছবি আঁকা প্রায় বন্ধ হতে চলেছিল। আসলে নেশা আর পেশার মধ্যে একটা ফারাক তৈরি হচ্ছিল। তাই চেষ্টা করতে থাকে একটা সরকারী চাকরির। টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকায় কিছুদিনের চেষ্টাতেই পেয়েও যায় সে। লক্ষ্মীর মতে এরপর জীবনটা যেন অনেকটা সহজ হয়ে যায় তাঁর কাছে। ভালো মাইনার সাথে সাথে অনেকটা সময় পায় সে নিজের কাজ করার জন্য। ছবি আঁকা শেখানো আর শেখা দুটোই এখন পুরো দমে চালায় সে। চাকরি সূত্রে বর্তমানে সে রাজগিরের বাসিন্দা। সেখানে অনেক কাজ পাচ্ছে সে। মণ্ডপ সজ্জা থেকে শুরু করে, মানুষের মনের মতো করে তাঁদের ঘরের দেওয়াল রং করে দিয়ে বেশ আনন্দেই তাঁর দিন কাটে। অফিস ছাড়া বাকি সময়টা সে এইভাবেই ডুবে যায় নিজের নেশাতে।

লক্ষ্মী আমাদের বলছিল যে ভবিষ্যতে নিজের একটা ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের ব্যবসা খোলার ইচ্ছা আছে তাঁর। আসলে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যতা ভরসা দেয়না ঝুঁকি নিতে। কিন্তু ব্যবসা করার ইচ্ছাটা মনে তোলা আছে তাঁর। তাই চাকরির জমানো টাকা আর ছোট কাজের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে তাঁর ভবিষ্যতের পূঁজি জোগাড় করে রাখছে এখন থেকেই।