শিক্ষা থেকে গ্ল্যামদুনিয়া অবাধে বিচরণ সুতপার

শিক্ষা থেকে গ্ল্যামদুনিয়া অবাধে বিচরণ সুতপার

Wednesday December 23, 2015,

4 min Read

পেশায় শিক্ষাবিদ। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। তবে ইদানিং টলিউডের আনাচে কানাচে কান পাতলে তাঁর নাম শোনা যায়। তিনি, সুতপা বসু। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া হর হর ব্যোমকেশের পোস্টার, টাইটেল কার্ড সব জায়গাতেই গীতিকার হিসেবে যাঁর নাম আমরা দেখেছি। বাঙালি হলেও তাঁর লেখা এখনও পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া দুটি গানই হিন্দি ভাষায়। সুতপার সঙ্গে যে অল্প সময়ের পরিচয় তাতে এটুকু বুঝেছি, তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে দু-এক কথায় শেষ করা অসম্ভব। প্রাণোচ্ছ্বল, সদা হাস্যমুখ, জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে চাওয়া সুতপাকে আরও খানিকটা কাছ থেকে চেনার চেষ্টা করল ইওর স্টোরি।

image


কলকাতার অদূরে শ্যামনগরে জন্ম সুতপার। বাবা, মা দুজনেই শিক্ষক। ফলে বাড়িতে পড়াশুনোর পরিবেশ ছিলই। সঙ্গে ছিল গানবাজনার চর্চাও। একদিকে যেমন ছোট থেকেই রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলদের লেখা পড়ে বড় হয়েছেন, তেমনই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ার দরুণ হিন্দি এবং ইংরেজী সাহিত্যের সঙ্গেও সমানভাবে পরিচয় ছিল তাঁর। ক্লাস সেভেন, এইট থেকেই লিখতে শুরু করেন সুতপা। লেখার কোনও নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ছিল না। যা ভালো লাগত, তাই নিয়েই লিখতেন। যেমন অনেকেই লেখেন। তবে একটা বিষয়ে কিন্তু সুতপা তখন থেকেই সবার চেয়ে আলাদা। সেই অল্প বয়স থেকেই তিনি সব লেখাই লিখতেন ছন্দ মিলিয়ে। এবং প্রত্যেকটা লেখায় নিজেই সুর দিতেন। তবে ছোটবেলার সেই অভ্যেস যে কোনওদিন তাঁকে কোনও স্বীকৃতি এনে দিতে পারে তা সুতপা স্বপ্নেও ভাবেননি।

আর পাঁচজনের মতোই স্কুলের পর কলেজ - এবং উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরি করতে শুরু করেন সুতপা। এই মুহূর্তে শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত একটি নামী সংস্থার বড় পোস্টে কাজ করেন তিনি। এপর্যন্ত সবটাই খুব সাধারন, অনেকটা ছকে বাঁধা গল্পের মতো। কিন্তু জীবন তো সবসময় চমকে ভরা। কথায় বলে, জীবনে কখন কী হয়, কেউ জানে না। এমন কিছু কিছু ঘটনা, কয়েকটি মুহূর্ত থাকে যা কোনও কোনও মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সুতপার জন্যেও ঠিক তেমনই এক চমক অপেক্ষা করছিল। একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট তাঁর জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দিল। এই সাইটটিতে জনপ্রিয় পারকশনিস্ট এবং সুরকার বিক্রম ঘোষকে ফলো করতেন সুতপা।হঠাৎই একদিন তিনি দেখেন, কোনও একটি প্রজেক্টের জন্য হিন্দিতে লিখতে পারেন এমন কোনও ব্যক্তির সন্ধান করছেন বিক্রম ঘোষ। খানিকটা খেয়ালবশেই তিনি বিক্রম ঘোষের ইনবক্সে একটি মেসেজ পাঠান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মেজেসের উত্তর চলে আসে। সুতপার লেখা দেখতে চেয়েছিলেন বিক্রম ঘোষ। লেখা পাঠানো হয়। প্রথমে লেখা খুব একটা ফিল্মি নয় বলে বাতিলও হয়ে যায়। তবে সুতপার লেখার ধরণ বিক্রম ঘোষের ভালো লেগেছিল। তাই তিনি সুতপাকে ফিল্মের ধাঁচে একটি গান লিখে পাঠাতে বলেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েননি সুতপা। মাত্র পনেরো মিনিটে সম্পূর্ণ নতুন একটি গান লিখে ফেলেন তিনি। বিক্রম ঘোষকে পাঠিয়েও দেন। তারপর, সেই বহুলপ্রচলিত আপ্তবাক্যটির মতোই বলতে হয়, "Rest is History..."

বিক্রম ঘোষ সেই সময় পরিচালক অরিন্দম শীলের পরবর্তী ছবি, হর হর ব্যোমকেশের জন্য কাজ করছিলেন। সুতপার লেখা অরিন্দমবাবুরও পছন্দ হয়ে যায়। ছবিতে একটি সাওন এবং একটি চৈতী লেখার কথা বলা হয় তাঁকে। সুতপাও পরপর 'সাওন আয়ো রি', 'রুঠে সাজন ক্যায়সে'-র মতো গানগুলি লিখে ফেললেন। ছবির গান রিলিজ হওয়ামাত্র চার্টবাস্টারে জায়গা পেল। তবে সবচেয়ে বড় কথা, সুতপার লেখা অবাক করল সকলকে। ছবির মিউজিক লঞ্চে, বিক্রম ঘোষ তো বলেই ফেললেন, কোনও বাঙালি এভাবে হিন্দিতে, বলা ভালো শুদ্ধ হিন্দিতে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি।

সুতপা এই নতুন পাওয়া স্টারডম পুরোপুরি উপভোগ করছেন। বিনোদন দুনিয়ায় তিনি কিন্তু ক্ষণিকের অতিথি নন। ইতিমধ্যেই বিক্রম ঘোষের পরবর্তী অ্যালবামের জন্য গান লিখে ফেলেছেন তিনি। হরিহরন, উস্তাদ রাশিদ খানের মতো সঙ্গীতজগতের দিকপালরা সুতপার লেখা গান গাইছেন। হাতে রয়েছে বলিউডের আরও বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট। তবে এই নতুন স্টেটাস পছন্দ করলেও চাকরি ছাড়তে কিন্তু নারাজ সুতপা। কারণ তিনি যা-ই করেন, ভালোবেসে করেন। গানের মতোই শিক্ষাজগতটাও তাঁর নেশা, প্যাশন বলা যেতে পারে। তাই দুটো কাজ সমানতালেই চালিয়ে যেতে চান তিনি।

ধীরে ধীরে শিল্পজগতেও একজন পেশাদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন সুতপা। তাঁর সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, ব্যক্তি সুতপার প্রতিফলন শিল্পী সুতপার মধ্যে ১০০ শতাংশ রয়েছে। তাঁর প্রাণখোলা হাসি, সমস্ত বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব - সবই যেন তাঁর গানের কথায় প্রতিফলিত হয়। অন্য অনেকের মতো লিখতে গেলে তাঁকে সকলের আড়ালে, একাকী বসে থাকতে হয় না। সুতপা বলেন, "আমি তো সংসারের কাজ করতে করতেও গান লিখি। প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার কাছে নতুন। যেকোনও বিষয় থেকে, যেকোনও মানুষের কাছ থেকে আমি নতুন কিছু শিখি।" আজকের এই জটিল পরিবেশেও জীবনকে খুব সহজভাবে দেখতে পারেন সুতপা। প্রকৃতির কোলে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। সময় পেলেই ব্যাগ গুছিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন। বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত তিনি শুধুই উপভোগ করতে চান। ভালো থাকতে চান, আশপাশের সকলকে ভালো রাখতে চান। ছোট ছোট জিনিস তাঁকে আনন্দ দেয়। ছবির পোস্টারে নিজের নাম দেখে উচ্ছ্বসিত হন। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। ব্যক্তিজীবনে সুতপার সারল্যই তাঁকে সকলের চেয়ে আলাদা করে তোলে।

জীবনে তিনি কখনও পরিকল্পনা করেননি। যা স্বপ্নেও ভাবেননি তা আজ তাঁর বাস্তব। আর এই প্রতিটি অভিজ্ঞতায়, প্রতিক্ষণে তাঁর পাশে থাকার জন্য সুতপা ধন্যবাদ জানান তাঁর জীবনসঙ্গী এবং সবচেয়ে ভালো বন্ধু, শাশ্বত বসুকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চান বিক্রম ঘোষ, অরিন্দম শীলের মতো ব্যক্তিত্ত্বদের, যাঁরা তাঁর উপর বিশ্বাস রেখেছেন। জীবনের প্রত্যেক বাধা এভাবেই হাসিমুখে, নির্ভীকচিত্তে অতিক্রম করতে চান সুতপা। আর বলতে চান, "নিজের মনের কথা শোনো, মনের জানালা খোলা রাখো, সাফল্য কখন নিজে থেকেই তোমার কাছে চলে আসবে, তুমি টেরও পাবে না।"