টিনের চালা। দেওয়ালের হলদেটে রং খয়েটে গিয়েছে। নকুবাড় প্রথমিক বিদ্যালয় লেখাটাও শেওলায় ঢাকা পড়েছে সেই কবে। তবু যত দিন গিয়েছে স্কুলের প্রতি ভালোবাসার বাঁধন আরও দড় হয়েছে। গেঁথে বসেছে নিত্যদিনের রুটিনের একটা বড় অংশজুড়ে। আর তাইতো অবসরের পরও স্কুল ছাড়তে পারেননি তপন মাস্টার।
ছাড়বেনই বা কীভাবে। তপন চন্দ্রের কাছে নকুবাড় তো শুধু স্কুল নয়, শরীরেরই আরেকটা অঙ্গ। কেন জানতে হলে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ১৯৮৫ সাল। হাওড়া ও হুগলি জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম নকুবাড় তখন হতদরিদ্র, শিক্ষার আলো যেখানে রাতের কুপির মতো টিমটিমে। গ্রামের লোকজনের পেশা বলতে চাষবাস। পড়াশোনার বালাই নেই। সন্তানরা একটু বড় হতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগানো ছাড়া উপায়ই বা কী। এহেন গণ্ডগ্রামে স্কুল বানাবেন ঠিক করলেন তপনবাবু। সেই শুরু। গ্রামের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে স্কুলের পরিকাঠামো তৈরি করেছেন। ভোর হতেই তপন মাস্টারের স্কুল থেকে ভেসে আসে অ, আ,ক,খ এর একটানা সুর। এখন রোজ মিড ডে মিলও পাচ্ছে পড়ুয়ারা।
এই স্কুলটিকে ঘিরে শিক্ষার আলো ছড়াতে থাকে নকুবাড় গ্রাম জুড়ে। গত ৩০ বছরে গ্রামের হাল ফিরেছে অনেকটাই। আরও স্কুল হয়েছে। ফলে নকুবাড়ে পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। তাতে অবশ্য তপন মাস্টারের আক্ষেপ নেই। গ্রাম শিক্ষিত হোক, এটাইতো চেয়েছিলেন। এই স্কুলে এখন শিক্ষকের সংখ্যা সাকুল্যে ২। তপনবাবু নিজে এবং প্রধান শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র শী। প্রধান শিক্ষক প্রশাসনিক কাজে বাইরে বাইরে থাকেন। অতএব স্কুলের ভার একা তপনবাবুর ওপর। যেটা বিশেষ করে বলতে হয়,সেটা হল তপন চন্দ্র এই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। অবসর নিলেও নিজের হাতে গড়া স্কুলের মায়া কাটাতে পারেননি। তাই পাশের গ্রাম ঝিকিরা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তা। খানা খন্দ পেরিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান। ‘খুদেগুলোর মুখ দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। ওরাই তো আমার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করে। যতদিন শরীরে কুলোবে স্কুলে আসতে চাই’।
গ্রামের মানুষও তপন মাস্টারকে ছাড়াতে রাজি নয়। ‘সুখে, দুখে গ্রামের ভরসা ছিলেন, এখনও আছেন। সেই মস্টারকে ছেড়ে বড় কাজে হাত দেওয়ার কথা ভাবতেই পারি না’, বলছিলেন সুজন মণ্ডল, গ্রামের এক বাসিন্দা। ছোট্ট স্কুল থেকে শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে গোটা গ্রামের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছেন তপন মাস্টার। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছেন। তারই ফল পাচ্ছে নকুবাড় গ্রাম।