ক্যানভাসে জীবনের জয়গান গেয়েছেন অপর্ণা
সময় এগোয়। কিন্তু শিল্পীর হৃদয়ে সময় কি দাগ কাটে? সেসব জলের রেখা নাকি চারকোলের আঁচড়, নাকি অ্যাক্রিলিকের। অপর্ণা কাউরের গোটা জীবনটাই মিক্সড মিডিয়া। সময় দাগ কাটেনি। কিন্তু উপহার দিয়েছে অনবদ্য অভিজ্ঞতা। সমৃদ্ধ করেছে তাঁর প্রেমকে। তিনি ষাট পেরনো এক প্রেমিক হৃদয়। এঁকেছেন প্রেমের বিজয়ের গাঁথা। কলকাতার ইমামি চিসেল আর্ট গ্যালারিতে চলছে তাঁর ছবির প্রদর্শনী। চিত্রশিল্পী অপর্ণা কৌর। তাঁর শিল্পী জীবনের প্রথম দিকের দিনগুলির মতই আজও তিনি সমান সৃষ্টিশীল।
দেশের অন্যান্য শহরে তার "বিয়ন্ত ৬০" প্রদর্শণী নিয়ে ঘোরার পথে আপাতত তার তরি এসে থেমেছে কলকাতায়। শিল্পীর নিজের কথায়,"দীর্ঘ বারো বছর পর আমি এলাম কলকাতায় আবার একক প্রদর্শণী করতে এলাম। গত ৩৫ বছরের প্রায় একশোরও বেশি কাজ এই প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে। বিয়ন্ত ৬০ আমার কাছে শুধু একটি প্রদর্শণী নয়। আমার দীর্ঘ চার দশকের শিল্পী সত্ত্বার দলিল। এতে আমার কাজের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন দর্শকরা।"
পদ্মশ্রী প্রাপক লেখিকা মা অজিত কাউরের মেয়ে অপর্ণা। ছোটোবেলাতেই পেয়েছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড়ের স্বাদ। ভারতবর্ষে পুরাতন ও নবীনের, গ্রাম ও শহরের সহাবস্থান তাকে উদ্বুদ্ধ করে এসেছে।এই বৈচিত্র্যের ঝলক তারা কাজের মধ্যে বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন অপর্ণা। তার কাজে বারবার ফিরে এসেছে নারী, প্রকৃতি, প্রেম, দেশপ্রেম, দেশভাগ ও উগ্রপন্থা বা সন্ত্রাসের মত বিষয়। তবে সব থেকে উজ্জ্বল প্রেমের জয়জয়কার। নানক, কবীর মীরাবাঈয়ের অনুষঙ্গও এসেছে তাঁর ক্যানভাসে। ছবিতে বরাবরই ভারতীয় নারীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর ভাবনা। কখনও মনে হতে পারে স্যুররিয়ালিস্ট কখনও ইমপ্রেসনিস্ট আসলে ক্যানভাসে এঁকেছেন একএকটি কবিতা।
শুরু থেকেই বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকার ঝোঁক অপর্ণার। তাই ১৯৯৫ এ যখন জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছবি আঁকার আমন্ত্রণ আসে। "Where have all the flowers gone" নামের তিনটি ছবির বিশাল ক্যানভাসে বিস্ফোরণের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলেন তিনি। ভারতীয় শিল্পের মধ্যে এই আন্তর্জাতিক ভাবাদর্শের সফল প্রতিফলন করতে পারাই অপর্ণার বৈশিষ্ট্য। তাই গ্লাসগো, লন্ডন, বার্লিন, আমস্টারডাম, নিউইয়র্কের মতো শহরে তাঁর প্রদর্শনী সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিদেশের সংগ্রহশালায় তার ছবি সহজেই জায়গা করেছে। তবে চার দশক পেরিয়েও ছবির ফর্ম ও মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অভ্যাস ছাড়েননি অপর্ণা। তাই এবারে কলকাতার চিত্র প্রেমিকেরা তাঁর জল রং, এচিং, কাঠ কয়লার কালি এবং জল রঙের মিশ্র মাধ্যম আর জিঙ্ক প্লেটের কাজ দেখতে পাবেন। তাঁর এই নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহসকেই কুর্ণিশ জানালেন অভিনেত্রী পল্লবী চ্যাটার্জী। প্রদর্শনীর উদ্বোধনে এসে তিনি বললেন,"অনেকেই ভাবেন চল্লিশ বছরের পর মহিলাদের আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু তাঁদের এই ধারণা ভেঙে দেবে অপর্ণার কাজ। বয়স যে সৃজনশীলতার পথের অন্তরায় নয় তা আরও একবার বোঝালেন অপর্ণা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন শিল্পীর কাজের সরলতা এবং রঙ-এর ব্যবহার তার নজর কেড়েছে।অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর এবং নৃত্যশিল্পী তনুশ্রী শঙ্করও মুগ্ধ অপর্ণার মিনিয়েচার পেন্টিং এবং নারীচরিত্র চিত্রণে।
প্রায় ১০০ ছবির মাধ্যমে অপর্ণা ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন তার পাশের বাড়ির মহিলা, থেকে চারপাশের সমাজ ও লাদাখের ল্যান্ডস্কেপ সবকিছুই। কিন্তু প্রদর্শনীর মধ্যে একটি ছবি যেন বিশেষ ভাবে মনে করাল কেন তার ছবিকে সময়ের দলিল বলা হয়। প্রদর্শনীর একটি এচিং "soledier's mother" বা সৈনিকের মা। তাঁর বিষণ্ণতা যেন সব সময়ই প্রাসঙ্গিক। পাঠানকোটে শহিদ সৈনিকের মায়ের কান্নার অনুরণন যেন এই ছবিতে ফুটে উঠেছে। আর তাঁর কাজ দেশ কালের সীমা পেরিয়ে চলেছে সময়কে জয় করার এক অনন্ত যাত্রায়।