স্বপ্নে বিভোর বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম মেটেলডাঙ্গা

স্বপ্নে বিভোর বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম মেটেলডাঙ্গা

Tuesday November 24, 2015,

6 min Read

হার না মানা অদম্য মনের জোরে ধীরে ধীরে সার্বিক স্বনির্ভর হয়ে উঠছে মেটেলডাঙ্গা গ্রাম। তাদের এই উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল মল্লারপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নইসুভা’। এখন তাদের উদ্যোগ দেখে পাশে দাঁড়িয়েছে কলকাতার ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ, মল্লারপুর ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত, ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের মল্লারপুর শাখা এবং ওয়েবরেডা। নইসুভার পাশে দাঁড়িয়ে মেটেলডাঙাকে আদর্শ সৌরগ্রাম প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত করে ওয়েবরেডা। সমস্ত বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে বিনামূল্যে। আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গ্রামে আজ একশো শতাংশ মানুষ সাক্ষর। মাধ্যমিকের গণ্ডিতে পা রেখেছে পাঁচ জন ছেলে মেয়ে। প্রত্যেকের বাড়িতে জ্বলছে সৌর বিদ্যুৎ। মাথার পিছনে ঘুরছে টেবিল ফ্যান।


image


সালটা ২০০০। ভয়াবহ বন্যায় আর পাঁচটা গ্রামের মতো ধুয়ে মুছে নিয়ে গিয়েছিল বীরভূমের ময়ূরেশ্বর থানার মেটেলডাঙা আদিবাসী গ্রামকেও। অভুক্ত ২৩ টি পরিবার প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী কুমাড্ডা গ্রামে। বন্যার জল নামতেই কুমাড্ডা গ্রামে গিয়ে আদিবাসী মানুষ গুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নইসুভার সভাপতি প্রয়াত অশোক কুমার পাঠক। কয়েকদিন তাদের অন্নসংস্থানের পাশাপাশি তাদের স্বনির্ভর করার স্বপ্ন দেখিয়ে পুনরায় গ্রামে ফিরিয়ে এনেছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। প্রথম দিকে সংস্থার কর্মকর্তারা নিজেরাই আর্থিক সাহায্য দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়ে দিয়ে ছিল। তাদের উদ্যোগেই আদিবাসীদের ১০ দিনের পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল প্রায় এককিলোমিটার মাটির রাস্তা। সেই রাস্তায় মল্লারপুর ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত মোড়াম বিছিয়ে চলাচলের যোগ্য করে তোলে। এর মাঝে ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ হয়ে মারা যান অশোকবাবু। তবে তাতেও থেমে যায়নি গ্রাম গড়ার উদ্যোগ। স্বামীর দেখানো পথে হেঁটে আদিবাসীদের পাশে থেকে তাদের উন্নয়নের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন সহধর্মিণী সোমা পাঠক।


image


আদিবাসীদের ঘুরে দাঁড়ান সেই শুরু। সার্বিক স্বনির্ভর হতে আদিবাসীরা নিজেরাই শুরু করেন শূকর চাষ এবং কৃষি কাজ। অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে ধানের ভাগ নিয়ে চাল তৈরি করে তা বাজারজাত করছেন। নিজেরা গড়ে তুলেছেন নার্সারি। মহিলারা হাতের কাজ করে সংসারে কিছুটা সাহায্য করছেন। আস্তে আস্তে গ্রামে তৈরি হয় শিশুরক্ষণাগার। ২০০৫ সালে কলকাতার ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন এমপ্লয়িজ কো- অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি একটি পাকা বাড়ি বানিয়ে দেয়। নাম দেওয়া হয় “অমৃত সদন”। সামাজিক উন্নয়ন এবং স্ব-ক্ষমতা অর্জনের কেন্দ্র হিসাবে ওই ঘর নির্মাণ করা হয়। শুধু ঘর নির্মাণই নয়, সংস্থার কর্ণধার অমিত চট্টোপাধ্যায়, আশিস রায়, জগবন্ধু চট্টরাজরা প্রতি বছর দুর্গা পুজোর আগে ওই আদিবাসী গ্রামে এসে ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কাপড় দিয়ে যান। ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট মল্লারপুর শাখার স্টেট ব্যাঙ্ক গ্রামটিকে ‘আপনা গাঁও’ হিসাবে ঘোষনা করে। শিশুদের স্কুল পোষাক দেওয়ার পাশাপাশি তারা গ্রামবাসীদের শূন্য টাকায় ব্যাঙ্কের খাতা খুলে দেয়। গ্রামের ২৩ টি পরিবারকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে ২৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়। ওই টাকায় তারা শূকর চাষ করে অনেকটা আর্থিক অনটন ঘুচিয়েছে। ওই এলাকায় কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি করার জন্য ২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করা হয়েছে। জায়গার অভাবে জৈব সার তৈরির কাজ এখনও শুরু করতে পারেনি তারা। জায়গার খোঁজ চলছে বলে জানান সংস্থার সম্পাদক সাধন সিনহা। জায়গা পেলেই কাজ শুরু করা হবে। ২০১০ সালের ১৬ জানুয়ারি মেটেলডাঙা গ্রামের ২৩ টি বাড়িতে সৌর বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় পশ্চিমবঙ্গ পুনঃনবিকরন যোগ্য শক্তি উন্নয়ন সংস্থা। সেই সঙ্গে গ্রামের রাস্তায় দুটি স্ট্রিট লাইট দেওয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে আলো জ্বালিয়ে সৌর বিদ্যুতের উদ্বোধন করেছিলেন সংস্থার অধিকর্তা সুশোভন ভট্টাচার্য। ওইদিনই মেটেলডাঙা গ্রামটিকে আদর্শ সৌরগ্রাম হিসাবে ঘোষণা করেন সুশোভনবাবু। তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামবাসীরা যেভাবে স্বনির্ভর হচ্ছেন তাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা সৌর বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে কিছুটা সাহায্য করলাম। যাতে ওদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে। মেয়েরা রাতের দিকে কিছুটা হাতের কাজ করতে পারে।’ ওই বছরের ১৮ এপ্রিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিটি বাড়িতে একটি করে টেবিল ফ্যান তুলে দেওয়া হয়। গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুবিধার্থে কমিউনিটি শৌচাগার ও একটি টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করে দেয় নেহেরু যুব কেন্দ্র। ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট আদিবাসী গ্রামে সার্বজনীন রন্ধনশালা চালু করে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের রামপুরহাট বাসন্তী গ্যাস এজেন্সি। আনুষ্ঠানিক ভাবে রন্ধনশালার উদ্বোধন করেছিলেন ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের বর্ধমান বিদায়ী রিজিওন্যাল ম্যানেজার সমীর কুমার ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের সেলস ম্যানেজার সন্তোষ কুমার, রামপুরহাট বাসন্তী গ্যাস এজেন্সির কর্ণধার শিবনাথ চক্রবর্তী, ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের বর্ধমান নবনিযুক্ত রিজিওন্যাল ম্যানেজার সুভাষচন্দ্র পতি। শিবনাথবাবু জানিয়ে ছিলেন, ‘আদিবাসীরা সাধারণত গ্যাসের কোন সংযোগ নেন না। তারা আজও গাছের ডাল কুড়িয়ে রান্না করেন। বর্ষায় তাদের রান্না করতে সমস্যা হয়। তবু তারা কষ্টের মধ্যে কাটান। তাই আমরা আদিবাসী গ্রাম মেডেলডাঙাকে বেছে নিয়েছি। প্রথমে চারটি সিলিন্ডার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাঁচটি উনুন দেওয়া হয়েছে। পরে রান্না করতে গেলে ঘন্টা হিসাবে তাদের পয়সা দিতে হবে। গ্রামের কালীদাস টুডুকে রন্ধন শালার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ মল্লারপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নইসুভা’র উদ্যোগে তৈরি রন্ধানশালা নির্মাণ করতে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক সাহায্য করে ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া ‘ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি ২০ ও নেহেরু যুবকেন্দ্র ২০ হাজার টাকা সাহায্য করে। এতে আদিবাসী ২৩ টি পরিবারের সুবিধা হয়েছে যথেষ্ট। কারণ সব সময় গাছের ডাল পাওয়া যায় না এলাকায়। সেসময় ওই সমস্ত পরিবার রন্ধনশালায় এসে রান্না করে নিয়ে যান। এবার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ২৩ টি পরিবারকেই রান্নার গ্যাস এবং উনুন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


image


সৌর বিদ্যুৎ পেয়ে খুশি গ্রামের আদিবাসী মহিলারা। তাঁরা বলেন, ‘বাড়িতে বিদ্যুৎ আসায় ছেলেমেয়েরা রাতে পড়াশোনা করার পাশাপাশি আমরা হাতের কাজ করতে পারছি।’ নইসুভার সম্পাদক সাধন সিনহা বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল আদিবাসীদের নিজের পায়ে দাঁড় করানো। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে রাস্তা তৈরির পাশাপাশি একটি চালাঘরে শুরু করা হয় রাজীব গান্ধী জাতীয় শিশু রক্ষণাগার। গ্রামের বাবুলাল টুডু ৫ কাঠা জায়গা স্বেচ্ছায় দান করেন। ২০০৫ সালে আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ন্যাশানাল স্যাম্পের সার্ভে এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটির পক্ষ থেকে সেই জায়গায় একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়। সেখানেই শুরু হয় মানুষ গড়ার কাজ। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ বাড়াতে রবিলাল মুর্মু নামে এক যুবককে গ্রামে নিয়ে আসা হয়। সেই গ্রামের শিশুদের নিয়মিত শিক্ষাদান করতে শুরু করেন। পরে ওই ঘরেই শুরু হয় শিশু শিক্ষা কেন্দ্র এবং অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র। পরে অবশ্য পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র নির্মাণ করে দেয়। বর্তমানে ওই গ্রামের পাঁচ জন ছেলেমেয়ে মাধ্যমিকে বসবে। খুকুমনি টুডু, সুমি মাড্ডি, সরস্বতী মাড্ডিরা মল্লারপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং সাহেব মাড্ডি, মঙ্গল মাড্ডিরা মল্লারপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক দেবে”। সুমি এবং খুকুমনি গতবার মাধ্যমিকে বসলেও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তাই এবার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে গ্রামে কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে আশেপাশের পাঁচটি স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাঠদান করে চলেছেন। ওই কোচিং সেন্টারে বর্তমানে ৫৫ জন পড়াশোনা করছে। নইশুভার সম্পাদক সাধন সিনহা বলেন, ‘আমরা গ্রামবাসীদের স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে পুনরায় গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। গ্রামবাসীদের আলোয় ফেরাতে ওয়েবরেডা, ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। সকলেই আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে কম বেশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গ্রামে বিদুত্যের ব্যবস্থা করে দেওয়ায় স্বপ্ন কিছুটা হলেও বাস্তব রূপ দিতে পারলাম। আমাদের হাত ধরেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা আজ মাধ্যমিকের গণ্ডিতে পা দিয়েছে।’ সংস্থার সভাপতি সোমা পাঠক বলেন, ‘স্বামী একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসা করার পাশাপাশি সমাজ সেবা করতে ভালোবাসতেন। সেই কারনেই ছুটে গিয়েছিলেন আদবাসি মানুষগুলোর পাশে। কিন্তু তিনি নিজে শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে পারেননি। তাই আমি স্বামীর অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি। আমি সাধ্য মতো তাদের পাশে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের সাথী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওই গ্রামের প্রতি ছেলেমেয়েকে যখন শিক্ষিত করে তুলতে পারব তখনই আমার স্বামীর স্বপ্ন পূরণ হবে। সেই লক্ষ্যে আমি এগিয়ে যাব”। ময়ূরেশ্বর ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্র মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। কিভাবে একটি গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর করে তুলতে হয় তা তাদের কাছেই শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যে উদ্দেশ্যে গড়া তাতে তারা সফল বলে আমি মনে করি”। অতিরিক্ত জেলা শাসক (জেলা পরিষদ) বিধান রায় বলেন, ‘ওই সংস্থার কাজ আমার খুব ভালো লেগেছে। এরকম ভাবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গুলি এগিয়ে এলে বীরভূমের গ্রামের সংজ্ঞা পাল্টে যাবে”। বিদায়ী জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক মানস দাস বলেন, “ওই সংস্থা সব কাজটাই নিজে হাতে করে। আমি লক্ষ্য করেছি কাজের মধ্যে দিয়ে ওরা টিকে থাকতে চায়। সমাজসেবা ওই সংস্থার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে’।

লেখক আশিস মণ্ডল