ছেলেবেলায় আমাদের স্কুলের রুটিনে অনেক বিদ্ঘুটে ক্লাস থাকত। রান্না শেখার ক্লাস, শারীরশিক্ষা বা সাঁতারের পিরিয়ড। শুধু লেখাপড়া নয়, আরও অন্যান্য বিষয়েও আমাদের চৌকস করে তোলার প্রশিক্ষণ চলত। শুনলাম আমাদের স্কুলে এখন ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক চালানোও শেখানো হয়। কে বলতে পারত গণ্ডির লেখা পড়ার বাইরে সেইসব বিষয়ে কামাল করে দেওয়ার যদি প্রতিভা থাকত আমাদের! পাশাপাশি নজর যেত প্রতিবেশী অবৈতনিক ভাঙ্গাচোরা স্কুলগুলির দিকেও। লেখাপড়াই হত অতিকষ্টে। গান, আঁকা, শারীর শিক্ষা এসব তো সেখানে অলীক স্বপ্ন। সরকারী পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা মাফিক ধার্য টাকাট ঠিকঠাক পড়া চলানোই সেখানে কঠিন ব্যাপার।
আজও দৃশ্যটা একই। তবে একদল মানুষ আছেন যাঁরা অন্যরকমভাবে খেলতে খেলতে শিক্ষায় বিশ্বাসী। বহু শিশু সামাজিক ও আর্থিক কারণে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এঁরা সেইসব পথবাসী শিশুদের শিক্ষিত করে তুলতে ব্রতী। জেমস ব্যাল্ডউইনের কথায় বাচ্চারা বড়দের কথা শুনুক বা নাই শুনুক,তাঁদের নকল করতে ওস্তাদ। এই ধারণা থেকেই জন্ম হয়েছে রিদম অব লাইফের।
রিদম অব লাইফ একটি NGO। এখানে শিশুদের খেলা ও কাজের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। এঁরা বলেন ‘ABC’ (activity based curriculum)।
তাঁরা বিশ্বাস করেন বাচ্চাদের চাপ দিয়ে কিছু শেখানো যায় না। শিশুরা দেখে শেখে। গত চার বছরে এঁরা সমাজে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনার লড়াই চালাচ্ছেন। প্রায় শ'তিনেক দরিদ্র শিশু এখানে পড়ে। সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেবিকা গুলাটির সঙ্গে কথা বলছিলাম। উনি জানালেন, ওঁরা চান বাধ্য হয়ে নয়, শেখার আনন্দে শিখুক শিশুরা। তাঁদের শিক্ষা পদ্ধতি সহজ। তবে ভীষণ প্রভাবশালী। তাঁরা আর পাঁচটা NGO-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। সপ্তাহে দুবার বিভিন্ন স্কুলে যান। নাচ,গান,নাটকের পাঠ চলে।
Delhi School, JD Tytler Senior Secondary School-এ নাচ ও নাটকের আয়োজন করেছিল রিদম অব লাইফ। তানিষা ও কাঞ্চন রিদম অব লাইফে নাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। দারুণ নাচে। দুজনেই স্কুলগুলি থেকে দ্বাদশ শ্রেণী অবধি লেখাপড়ার স্কলারশিপ পেয়েছে। তানিষা আমাদের বলল, সে নাচতে ভালোবাসে। টিভিতে নাচ দেখত। রিদম অব লাইফ যখন তাদের স্কুলে এল, কারা নাচে আগ্রহী জানতে চাইল সে তখন হাতে স্বর্গ পেল। সেই শুরু। পাঁচ বছর ধরে শনিবার আর সোমবার তানিষা অপেক্ষা করে কখন সে শিখতে পারবে নতুন ধরণের নাচ। দেবিকা বললেন, নির্ভুল ইংরেজিতে কথা বলে শিশুরা। খুব আনন্দ হয়। প্রতিটি বাচ্চার উন্নতি তাঁদের একমাত্র প্রাপ্তি। ধরুন প্রীতির উদাহরণ। তখন ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। বাড়ির আর্থিক সমস্যায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। দেবিকাদের ছত্রছায়ায় আজ সে National Institute of Open Schooling থেকে দশম শ্রেণীর পরীক্ষা দেবে।
যত কথা এগোচ্ছিল দেবিকার চোখের কোণ চিকচিক করছিল। বাচ্চাগুলো যখন প্রথমবার স্টেজে ওঠে রিদমের প্রতিটি শিক্ষকের ভিতর একটা দারুণ উত্তেজনা হয়। সবকটি শিশুর সঙ্গে কাটানো প্রতিটিই বিশেষ মুহূ্র্ত। ধীরে ধীরে বাচ্চারা তাঁদের ভালোবেসে ফেলে। জানতে চায় পরের দিনও তাঁরা আসবে কিনা,
"ভাইয়া,দিদি,আপ লোগ কাল ভি আওগে না?"
সময় শিশুদের আরও দক্ষ ও সাহসী করে তোলে। রিদম মাত্র ২০ টি বাচ্চা নিয়ে শুরু করেছিল। সংখ্যা বেড়েছে। এখানে প্রশিক্ষণ পাওয়া বাচ্চারাই বন্ধুদের বলেছে এখানকার গল্প। বলেছে তাদের মজাদার পড়াশোনার কথা।
আজ রিদমে সাড়ে তিনশ শিশু শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল। তাঁরা তিনটি বস্তির আরও সাড়ে তিনশ শিশুর নাম নথিভুক্ত করিয়েছে। দক্ষিণ দিল্লীর ধৌলা কুঁয়ায় এখন লেখা পড়ার ধূম। বিভিন্ন দরিদ্র পরিবারের পাঁচ থেকে পনেরোর বাচ্চারা জীবনের ছন্দে মাতোয়ারা।
ষোলো পেরিয়েছে যারা তাদের জন্যে অন্য শিক্ষা। হাতের কাজ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মুরোদ। রিদমের ক্যাম্পেন ‘Avsar’।
মেয়েদের মধুবনী শিল্পে দক্ষ করতে তুলছে অভসর। রিদম অব লাইফ সেইসব প্রোডাক্ট বাজারে বেচতে সাহায্য করবে। লাভের এক অংশ মেয়েরা পাবে এবং বাকিটা NGOর কাজে লাগবে। স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার আনন্দেই মেয়েরা শিখবে। ওদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে ভারত।