'অপয়া' মনতোষের পয়মন্ত শিল্প
একদিকে ডাই হয়ে পড়ে আছে ফেলে দেওয়া জিনিস পত্র। নারকেলের খোলা, কাঠকুটো এসব। আর এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক আপন খেয়ালে ঘাড় গুঁজে বানিয়ে চলেছেন সেই সব আবর্জনা থেকে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। পশ্চিমবঙ্গ হস্তশিল্প মেলার কারুভাষা প্যাভিলিয়নে তখন একটু একটু করে ভিড় জমছে। লোকটিকে ঘিরেও অনেক মানুষ। সবাই দেখছেন কীভাবে নারকেলের ফেলে দেওয়া মালাই চাকি থেকে তৈরি হয়ে যাচ্ছে কাপ ডিস, চামচ হাতা। ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফি। রবীন্দ্রনাথের মুখ। মুগ্ধ নয়নে ম্যাজিক দেখতে ভিড় বাড়ছে। ভিড়ে আমিও আছি। লোকটার মুখে কখনও না-মেলানো অনাবিল হাসি। ওটাই যেন ওঁর পারমানেন্ট স্ট্যাটাস সিম্বল। কেউ প্রশ্ন করলে মৃদু ভাষায় উত্তর দিচ্ছেন। চোখ এড়ালো না হাসি মুখে ঢাকা পড়া উদাসীনতা। কথা বলতে চাইলাম। দেখলাম মানুষটা একেবারেই মাটির মানুষ। ভদ্রলোকের নাম মনোতোষ মাইতি। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁওশী গ্রামে।
পুঁথিগত বিদ্যা নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম যে আমাদের অনেকের থেকেই নীতি আর জীবনদর্শনে অনেকটাই এগিয়ে এই সরল সাদাসিধে লোকটি। বলছিলেন তিনি পরিবারের সবথেকে ছোটোছেলে। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই বাবা মারা যান। ফলত গ্রাম্য ধারণা থেকেই ওঁর জন্য তৈরি হতে থাকে একটা কঠিন বাস্তব। নিজের মা থেকে গোটা পরিবারের মনে করতে থাকে যে এই ছেলেটিই অপয়া।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার নামের পাশে বসে যায় অপয়া তকমা। সাবলীল ভাবেই কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন মনতোষ। লক্ষ্য করলাম চোখের কোণটা চিকচিক করছে। চাপা অভিমান। ৬৬ বছর পরও।
পরিবারের সব কর্তব্য পালন করেছেন। কিন্তু তাচ্ছিল্য কমেনি। পড়াশুনা করার খুব ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকে। বলছিলেন, "কিন্তু কি জানেন বাড়ির লোকই যদি অপয়া ভাবতে থাকে তাহলে মানুষের শখ, আহ্লাদ বলে আর কিছু থাকেনা। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই তখন সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ"।
নারকেল খেয়ে খোলাটা ফেলেই দিই। আর মনতোষ সেটা কুঁড়িয়ে আনেন। বানিয়ে ফেলেন চা খাওয়ার কাপ। ঘর সাজানোর শিল্পসামগ্রী। ফেলে দেওয়া জিনিস যে ফেলে দেওয়ার নয় তা থেকে যে অমূল্য সব জিনিস বানানো যায় সেটা তাঁর নিজের জীবন থেকেই শিখেছেন মনতোষ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প মেলায় কারুভাষা প্যাভিলিয়ন। সরকারি উদ্যোগে রাজ্যের বিশেষ বিশেষ শিল্পীরা এখানে বসে তাদের শিল্পকর্ম দেখানোর সুযোগ পান। গত দুবছর এখানে বসার সুযোগ পাচ্ছেন মনতোষ। কথা প্রসঙ্গেই বলছিলেন যে একজন ম্যাডাম তাকে সুযোগ করে দিয়েছেন।
দুঃখ করছিলেন যে ‘মানুষের কাছে অনেক টাকা, কিন্তু শিল্পবোধটা ক’জনের থাকে বলুন! এখানে কত মানুষ আসেন, ঘোরেন, দেখেন, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, দাম জিজ্ঞাসা করেন কিন্তু কেনেন ক'জন? ক্রেতা বিক্রেতার দড়াদড়ি চলতে থাকে। কিন্তু যে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় সুন্দর হয়ে ওঠে তাদের ঘরদোর, বেডরুম, বারান্দা। তাঁরা কিন্তু পড়ে থাকেন অন্ধকারেই।
সবার সামনেই তিনি বানান ফুলদানি, ল্যাম্প-শেড। তাঁর স্ত্রীও তাঁকে সাহায্য করেন। সারাবছর এইসব জিনিস বানান। বিক্রি হয় রাজ্যের বিভিন্ন মেলায় আর কলকাতার হাতেগোণা কিছু শোরুমে। বছরে আয় হয় দেড় থেকে দুলক্ষ টাকা। বলছিলেন সঙ্গী পেলে বছরে ১০ লাখ টাকাও আয় করা সম্ভব। আগামী বছর এই হাতের কাজের দৌলতে গুজরাত যাচ্ছেন সস্ত্রীক। তবে ব্যবসা করতে নয়, যাচ্ছেন প্রশিক্ষণ দিতে। বলছিলেন নিজে কখনও কারো কাছে শেখেননি এই কাজ, কিন্তু এই শিল্পের প্রশিক্ষক হতে চলেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন রাজ্য থেকে যেভাবে দেশে পৌঁছচ্ছে তাঁর শিল্প তেমনি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়বে তার কাজ। মনতোষের মনে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন এখন আকৃতি পাচ্ছে। ফেলে দেওয়া নারকেল খোলা দিয়ে ওঁর হাতে যেমন আকার পেয়েছে বিশ্বকাপ।
উৎপাদন বাড়াতে হস্তশিল্প কে মেশিন শিল্পে পরিণত করতে রাজি নন মনতোষ। গ্রামে তার দুটো দোকান, মোট পাঁচ রকম ব্যবসা আছে। কিন্তু কোনওটাই নিজে চালান না। দুই ছেলে, বউমা আর নাতিদের নিয়ে তার সময় কেটে যায়, আর সাথে তো নিজের শখের শিল্প আছেই তাই অন্যান্য ব্যবসাগুলো দেখাশুনো করার ভার ছেড়ে দিয়েছেন ছেলে আর বউমাদের ওপর। বছরের বেশিরভাগ সময়ই বিভিন্ন মেলায় ঘুরে বেড়ান। নিজের সামগ্রী নিয়ে খোঁজেন শিল্পরসিক ক্রেতা। খোঁজেন অন্যদের সৃজনও।
মনতোষের সাথে কথা বলার সময় লক্ষ্য করছিলাম বারবার ঘুরেফিরে আসছিল ‘সততা’ শব্দটি। উনি মন থেকে বিশ্বাস করেন মানুষ যদি সতভাবে বাঁচার চেষ্টা করে তাহলে জীবনে আসলে কোন কষ্টই কষ্ট বলে মনে হয়না।
সরকারি ভাতা নেন না। তাঁর চেয়ে বেশি গরিব মানুষকে সাহায্য করতেই এই সীদ্ধান্ত। তাঁর ছোটো ছেলে অসামাজিক কাজে যুক্ত এমন অভিযোগ পাওয়ায় হৃদয়ে কঠিন হয়ে তাকে ত্যাজ্য পুত্র করেছেন। অন্যায়ের সাথে আপষ করেননি। তাবলে ছেলের পরিবারকে বঞ্চিতও করেননি। ছোট-বউমা থাকেন তার সাথেই, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য একটা মোবাইলের দোকানও খুলে দিয়েছেন তাঁকে। আসলে মনতোষের মতে মানসিক শান্তি থাকলে, দুবেলা দুমুঠো ভাতডালেও বেশ পেট ভরে যায়।