স্বপ্ন ভালবাসতেন ফিদেল কাস্ত্রো
বিপ্লবী প্রথমত একজন প্রেমিক। স্বপ্নের প্রেমই তাঁকে বিপ্লবে টেনে আনে। যখন কোনও স্বপ্ন থাকে না, তখনই তো স্বপ্ন দেখার সময়। এই এখন। লিখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংবাদিক প্রশান্ত ভট্টাচার্য।
লেনিন প্রায়ই বলতেন,"যে বলশেভিক স্বপ্ন দেখতে পারে না, সে একজন খারাপ বলশেভিক।" ফিদেল কাস্ত্রো সেই অর্থে একজন ভালো বলশেভিক। কেননা তিনি স্বপ্ন দেখতে পারতেন। তিনি ছিলেন আনখশির রোম্যান্টিক। আমি এখানে রোম্যান্টিক শব্দটা ব্যবহার করছি অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে। স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের আদি পিতা আন্দ্রে ব্রেতোঁ লিখেছিলেন, যে স্বপ্ন দেখতে পারেনা সে একটা গাধা। কোনও প্যারাডাইম শিফট না করে আমরা ব্রেতোঁ এবং লেনিনের কথাটিকে পাল্লায় তুলতে পারি। দেখব দুটোই সমান ভারী। সেই অর্থে স্বপ্ন দেখার রোম্যান্টিকটা না থাকলে বিপ্লবী বা কবি কোনওটাই হওয়া যায় না। ফিদেল সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর এখানেই থেমে থাকেননি। অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের তরুণ সমাজকে সেই স্বপ্ন ফেরি করেছেন। এখানেই কাস্ত্রো আর চে আধুনিক পৃথিবীর সব বিপ্লবী নেতার থেকে ভিন্ন। পদচিহ্নহীন এক পথের পথিক। লাতিন আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল লাল নক্ষত্র। একবার পথ চলে যাদের থেমে গেছে পথ চলার পিপাসা তারা কি করে বুঝবে ফিদেল মানে একটা নৌকো, যা সব সময়ই ভেসে চলে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ঢেউয়ের বিপ্রতীপে। ফিদেল মানে একটা প্রতিস্পর্ধা। যা এগারোটা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চোখে চোখ রেখে কথা বলে এবং চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য করে।
এতবড় ভূমিকা করলাম একটিই কারণে, এদেশে যারা এখন ফিদেল নিয় বড় বেত্তান্ত ফাঁদছে, তারা বা তাদের পূর্বসূরিরা কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোকে কোনওদিনই বিপ্লবী বলে আখ্যা দেয়নি। বরং তাদের ভাষ্যে ফিদেল একজন অ্যাডভেঞ্চারিস্ট মাত্র। এখন সিপিএম পলিটব্যুরো থেকে অবসর নেওয়া এক নেতা এই কলমচিকে গত শতাব্দীর আটের দশকে বলেছিলেন, “Cuban revolution is nothing but an adventure…” হরি নাম খাবলা খাবলা। পরে তারাই দেখি ফিদেল আর চে নিয়ে আদিখ্যেতা শুরু করলেন। আমি হলফ করে বলতে পারি ১৯৯০ সালের আগে সিপিএম, আরএসপি, এসইউসি-র মতো রাজনৈতিক দলগুলির মার্ক্সিয় পুস্তক বিপণীতে ফিদেল বা চে-র একটিও বই থাকত না। সবই ঘেঁটে ঘ করে দিলেন মিখাইল গোর্বাচেভ। ওঁর গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রৈকার ধাক্কায় সমাজতান্ত্রিক শিবিরে যখন সুনামি আছড়ে পড়ল তখন নৈবেদ্যের কলার মতো টিকে রইল কিউবা। আর যেহেতু এদেশের কমিউনিস্টদের শালগ্রাম শিলা ছাড়া চলে না। তাই তাঁরা ফিদেলকে বুকে রাখতে শুরু করলেন। অনেকটা চাঁদবেনের বাঁ হাতে পুজো দেওয়ার মতো। বেচারিদের এখন তাও রইল না।
আমাকে যে সিপএম নেতা কিউবার বিপ্লবকে অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া অন্য কিছু বলতে নারাজ ছিলেন, তাঁর প্রতি আমার কোনও বিরাগ নেই। কেননা টেক্সট বুক সম্মত কোনও বিপ্লব ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি সম্পন্ন করেননি ফিদেল। মহামতি লেনিন কথিত ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ মিলিয়ে এই বিপ্লবের চরিত্র নির্ণয় সম্ভব নয়। মার্কস-লেনিনের ধ্রুপদী পাঠ থেকে এই বিপ্লবের শ্রেণি চরিত্র বিচার করলে অবশ্যই তা গোটা কুড়ি পঁচিশ যুবকের একটা অভিযান বলেই মনে হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে কাস্ত্রো ও চে যখন কিউবাতে বিপ্লব করছেন, তখন কমিউনিস্ট ভাবলোক শাসন করছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। চিন তার লেফটেনেন্ট। তৈরি হচ্ছে ৮১ পার্টির দলিল, ১২ পার্টির দলিল। নিস্তালিনীকরণ অভিযান সবে শুরু করেছেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। এখন লেনিন রচিত পার্টি সংগঠনের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি কমিউনিস্ট পার্টি ও তার রণনীতি এবং রণকৌশলের ওপর নির্ভর না করে কোনও বিপ্লব করা সম্ভব? কোথাও কখনও হয়েছে! অতএব ওই একডজন দেড়েল, মুখে চুরুট নিয়ে গিটার বাজিয়ে আর চোরাগোপ্তা বন্দুক চালিয়ে বিপ্লব করে ফেলবে? আহাম্মকের মতো কথা বোলো না ছোড়া। ওটা একটা অ্যাডভেঞ্চার। বিপ্লব একটা সৃজনশীল আন্দোলনের অতি সুসংগঠিত শ্রেণি সংঘর্ষের একটি চূড়ান্ত স্তর।
আমি আজও বিশ্বাস করি ওই অনুশাসন থেকে কিউবার বিপ্লবের মতো কোনও বিপ্লব করা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের দোহাই, থুড়ি মার্কসের দোহাই ফিদেল, চে বা তাঁর সঙ্গীদের অমন কোনও অনুশাসন ছিল না। তাই কিউবা আজ সারা পৃথিবীর কাছে একটা চেনা নাম। আজও কোনও তরুণের চোখে লেগে থাকে চে আর কাস্ত্রোর অঞ্জন। জলপাই রঙের উর্দি, মুখে জ্বলন্ত চুরুট, অবিন্যস্ত দাড়ি, জামার ওপরের দিকে দুটো বোতাম খোলা, ঋজু সেই শরীরের চাউনি আজও বিপ্লবর নেশা ধরিয়ে দেয় অনর্গল কিশোরের মনে। আজ প্রৌঢ়ের পাঠশালায় এসেও মনে হয় প্রণত হই স্পন্দমান বিপ্লবী সত্তার কাছে।
দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে রাষ্ট্রের সবকটি শ্রেণির যথার্থ বিশ্লেষণ করে, বৈরি ও অবৈরিমূলক দ্বন্দ্বগুলোকে বিশ্লেষণ করে, বিপ্লবের মিত্রশক্তিগুলোকে একত্রিত করে, মধ্যপন্থীদের নিরপেক্ষ করে শিঙা ফুকে বিপ্লব কিউবাতে হয়নি যে একথা মানতেই হবে। কিন্তু অমন একটা অ্যাডভেঞ্চার মার্কা বিপ্লব না করেই যারা ফিদেল ও চে-র বিপ্লবী সত্তা এক ছটাক না তিন আনা বিচার করতেন, তাঁদের এখন ফিদেল নিয়ে এই উথলে ওঠা ভাবটা আমি নিতে পারি না। ধক নেই কিছু করার, শুধু এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চে-র মুখ ছাপা কালো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে গরম গরম বুকনি দেওয়াটাও নিতে পারি না। ওই চোঙাগুলি নানা কলরবে, শিক্ষকদের একাংশের স্পনসরশিপে, বিপ্লবের গুহ্য খুঁজে বেড়ায় আর শিক্ষান্তে চাকরিটি, ওদেশে বা এদেশে নিদেনপক্ষে ব্যাঙ্গালোরে ঠিক গুছিয়ে নিয়ে ধুম মাচায়। আর আরেক দল হয়েছে ফেবু-বিপ্লবী। শাম্মী কাপুর মরলেও RIP করে, ফিদেল মরলেও RIP করে। এইসব আমোদগেড়েদের বিপ্রতীপে এই ৯০ বছরের ফিদেলকে এখনও তরতাজা লাগে। দেখলেই বোঝা যায় বুঝি সর্বস্ব নয় এ জীবন। যেন বলতে পারেন, মনোবল ধাত্রী হলে প্রতি গর্ভ জুড়ে কিউবা হয় হয়, এখানেই পূবে বা উত্তুরে।
লেনিনীয় ভাষায় হয়তো ফিদেলের সবটাই ছিল ইনফেন্টাইল ডিজঅর্ডার। তবু এই শিশু সুলভ বিশৃঙ্খলাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। কেননা তা ছিল সুন্দর। ফিদেল নিজেও যেমন সুন্দর ছিলেন তেমন যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ টান। সুন্দর সমাজ, সুন্দর স্বাস্থ্য, সুন্দর নারী। কোনওটাকেই তিনি এড়িয়ে যাননি। নিন্দামন্দও শুনেছেন তাই অনেক। তবু এক জাদু বাস্তবতা তাঁকে টেনে নিয়ে চলতো। সিয়েরা মায়েস্ত্রার দিনগুলিতেও আবার আমেরিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সময়ও। তাই তো সাহিত্যে জাদু বাস্তবতার শিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ হন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পায়ে যাঁর জাদু-বাস্তবতা, সেই দিয়েগো মারাদোনাও তাঁর বন্ধু।
যখন কোনও স্বপ্ন নেই, তখনই তো স্বপ্ন দেখার সময়। এই এখন। শেষ করার আগে বলি, ১৯৭৩ সালে ফিদেল যখন দমদম বিমান বন্দরে এসেছিলেন, তখন এখানকার জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সুবোধ ব্যানার্জি সহ বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেই সময় তিনি নাকি জ্যোতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এতগুলো কমিউনিস্ট পার্টি কেন?” জ্যোতি বসু নাকি উত্তর দিতে পারেননি। সেই সময়ও এটা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হয়েছিল। এখনও হচ্ছে। আমারও ছোটবেলায় রাগ হত, কেন জ্যোতিবাবু উত্তর দিলেন না। বলতেই পারতেন, বিপ্লবের আগে রুশ দেশে, চিন দেশেও অনেকগুলো কমিউনিস্ট পার্টি ছিল। এখন বুঝি জ্যোতি বসু উত্তর না দিয়ে অতি বিবেচকের পরিচয় দিয়েছেন। কেননা অতিথিকে মান্য করতে হয়। আর দ্বিতীয়ত, কোনও কমিউনিস্ট পার্টি গঠন না করে বিপ্লব করায় তিনি এর অনিবার্যতাটা সহজে বুঝবেন না। মজার কথা অবোধেরা জ্যোতিবাবুকে করা ফিদেলের সেই প্রশ্নটা নিয়ে আজও খিল্লি করছে।