দারিদ্রের কাঁথায় 'পঙ্গু' জেলেবানুর মর্যাদার কারুকার্য
দাওয়ায় ছড়িয়ে রয়েছে সৃজনি কাঁথার উপর হরেক কিসিমের নকশা। প্রথম দেখায় মনে হল এ যেন নকশিকাঁথার মাঠ। জানতে পারলাম এক প্রতিবন্ধী তরুণীর হার না মানা জেদের কাছে হার মেনেছে শারীরিক অক্ষমতা। শৃঙ্গ জয়ই এখন তাঁর স্বপ্ন।
নাম জেলেবানু খাতুন। বাড়ি বীরভূমের রামপুরহাট ২ নম্বর ব্লকের হাঁসন ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত কৌড়া গ্রামে। পাঁচ বোনের মধ্যে তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। নিজে ৮০ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী। মা আলেয়া বিবি বলছিলেন, দশ মাস বয়সে জেলেবানু পোলিও আক্রান্ত হন। ডান পা অসাড় হয়ে যায়।
তবে সেটা তাঁর জীবনের সংগ্রামকে থামিয়ে দিতে পারেনি। গ্রামের স্কুলের প্রাথমিক পাঠ সেরে মনের জোরে বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মিল্কিডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোন। এই দুর্দমনীয় মেয়ে বিএ প্রথম বর্ষে ভর্তি হন রামপুরহাট আসলেহা কলেজে। রোজ হুইল চেয়ারে মাড়গ্রাম। সেখান থেকে বাস ধরে যেতেন রামপুরহাট। শারীরিক অসুবিধেকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এভাবেই রোজ ৩২ কিলোমিটার ডিঙিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে কলেজ পৌঁছতেন।
কিন্তু জমি বিবাদের জেরে কলেজ এখন বন্ধ। আপাতত পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। তবে এই সময়ের ফাঁকে আরবি শেখেন। রামপুরহাটের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শিখছেন কম্পিউটার। মা-দিদিদের সঙ্গে হাতে হাতে ফুটিয়ে তুলছেন সৃজনী কাঁথার উপর নকশা।
সুচের আঁচড়ে নকশা বাহার। কোনওটা তাজমহল। কোনওটা শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলার পৌরাণিক উপাখ্যান। মা আলেয়া বিবি বলেন, "হিন্দুমুসলিম নির্বিশেষে ক্রেতারাই ছেঁড়া কাপড় দিয়ে যান। সেগুলোকে সেলাই করে তার উপর ভালো কাপড় দিয়ে মুড়ে সুতোর সূক্ষ্ম সেলাইয়ে নকশা ফুটিয়ে তুলি। নকশার কাজটা করে জেলেবানুই। আমরা তাঁর সঙ্গে হাতে হাত মেলাই।" জানা গেল একটি সৃজনী কাঁথায় নকশা ফুটিয়ে আয় হয় পাঁচশো টাকা। তাতেই কোনক্রমে সংসার চলে। অভাবের তাড়নায় সব মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারেনি। একমাত্র জেলেবানু পরিবারে ব্যতিক্রম। নিজের জেদে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছেছেন। আরও পড়তে চান। আর কাঁথার উপর নকশা ফুটিয়েই দিন কাটে।
এখন জেলেবানুর হুইল চেয়ারের হাল খুবই খারাপ। ফলে ক্র্যাচই ভরসা। কারও কাছে হাত পাততে কুন্ঠা বোধ করেন আত্মসম্মানে ফুটতে থাকা জেলেবানু। জানেন লক্ষ্যে পৌঁছতে তাঁকে এখনও অনেকটা পথ এভাবেই পেরোতে হবে। শুধু জানেন না পথটা কতটা দীর্ঘ।