তিন চার কিলোমিটার হেঁটে এসে Tripti-র চা খায় কলকাতা

তিন চার কিলোমিটার হেঁটে এসে Tripti-র চা খায় কলকাতা

Sunday February 04, 2018,

4 min Read

চা তো চাইলে আমি আপনি বানাতেই পারি। তবু রাস্তায় বেরলে চা খাওয়ার একটা চল আছে। দেশের যে প্রান্তেই যান চা আপনি পাবেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে চাওয়ালা ব্র্যান্ডিংটা ব্যবহার করে গদিতে এসেছেন ফলে চা যে খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যবসা সে তো জলের মত পরিষ্কার। চা নিয়ে অনেক রকম বিলাসিতা হয়, অনেক আধুনিকতার মোড়কে চা পরিবেশন হয়। আর চা দিয়ে চমৎকার এক্সপেরিয়েন্স বিক্রি হয় গোটা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু রাস্তার কাটিং চায়ের দোকানেরও দারুণ রমরমা। বাগবাজারের ভোলা কইয়ের দোকানই বলুন আর সাদা কাপ ডিশে ডেকারস লেনের চা। ফুটপাথ জিন্দাবাদ। দক্ষিণ কলকাতার একটি ছেলে ফুটপাথেই খুলে ফেলেছেন তাঁর চায়ের স্টার্টআপ। 

image


আপনি ভাবছেন চায়ের দোকান আবার স্টার্টআপ হয় কীভাবে! তাহলে তো ফুচকাওয়ালা, পানওয়ালারাও স্টার্টআপ! তেলেভাজা আর পাকোড়ার অনুষঙ্গে তবে কেন এত অস্বস্তি! 

ওর চায়ের দোকানে এক বার না গেলে টের পাবেন না কেন ও স্টার্টআপ। গোটাটাই ওর ইনোভেশনে ভরা। ব্র্যান্ডিংয়ের তাগিদ আছে। স্কেল করার ইচ্ছে আছে। শাখা খুলে খুলে এগোনোর কথা ভাবছেন ছেলেটি। আর আছে চলতি বাজারের প্রচলিত ব্যবসাকে ডিসরাপ্ট করার অদম্য চেষ্টা।

ভাবছেন তো, চা মানে সে তো চা-ই। তার আবার ইনোভেশন কী! কথাটা বলতে গেলেই ফোঁস করে ওঠেন বিজয়। ছেলেটির নাম বিজয় শীল। বললেন, ওর দোকানের চায়ে জাফরানের কুচি পাবেন। মালাই পাবেন। চাইলে চকোলেট ফিউশনও পেয়ে যাবেন। রীতিমত আইস টি বিক্রি করেন ফুটপাথের এই দোকানে। চায়ের কাপে তুলসী আর পুদিনার তুফান তোলেন। হরেক কিসিমের চা বেচেন। মাটির ভাঁড়ে মালাই চা। গুজরাটি মশলা চা। জাপানি গ্রিন টি। প্রাচীন আয়ুর্বেদিক জরি বুটি দিয়ে তৈরি স্বাস্থ্যকর চা। কেবল দার্জিলিং, আসাম নয়, নীলগিরি আর শ্রীলঙ্কার চাও আছে। চাইতে পারেন কাশ্মীরী কাওয়া চা। পাবেন নতুন প্রজন্মের পছন্দের ক্রিমি চকোলেট কফি, চকোলেট ফিউশন। চা নিয়ে সারাদিন নানান গবেষণা করে চলেছেন বিজয়। চাফিও পারেন। চা আর কফির অনবদ্য মিলন। ইনোভেশন নয়! গ্রোথ গ্রাফটাও তরতর করে ঊর্ধ্বমুখী।

উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়াশুনো এগোয়নি। বাড়িতে ব্যবসা করেন সবাই। ও তবু চাকরি করে দেখতে চেয়েছিল স্বনির্ভর হওয়া যায় কিনা। ফ্লিপকার্ট থেকে শুরু করে নানা সংস্থায় চাকরি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মনে হয়েছে এসব ওর কম্ম নয়। চিরকাল স্বপ্ন দেখতেন নিজের কিছু একটা ব্যবসা হবে। শুরু হবে ছোট খাটো। কিন্তু নিজের তাগিদে সেটাকে বড় করবেন। বাড়ি গাড়ি হবে। লোকজন সম্মান করবে। খারাপ কাজ কখনও করবেন না। শুধু নিজের ব্যবসার টানেই রবীন্দ্র সরোবর মেট্রোর ৬ নম্বর গেটের সামনে একটা চায়ের দোকান দেন। দেখতে সাদামাটা আর পাঁচটা চায়ের দোকানের মতো হলেও বিজয় শীলের তৃপ্তি মোটেও সাধারণ নয়। সুস্বাদু চায়ের সঙ্গে ফিউশন করার আধুনিকতা আয়ত্ত করে ফেলেছেন ছেলেটি। চায়ের দোকানে মেনুকার্ড রীতিমত ডিজাইন করে বানিয়েছেন। দেখতে দেখতে বছর দুয়েক হয়ে গেল। নিত্যই লম্বা হচ্ছে মেনু কার্ড। সংযোজিত হচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবন। এই চকোলেট চায়ের আইডিয়াটাই ধরুন না কেন, সবে মাস দুয়েক হল ও শুরু করেছেন। কীভাবে? বলছেন, চকোলেট চা বড় বড় কাফেতে হয়। অনেক টাকা দাম। মধ্যবিত্তের নাগালে সহজলভ্য নয়। কিন্তু তাই বলে কি পিছিয়ে থাকবে বাঙালি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁ কাফের হুবহু টেস্ট ও ফুটপাথের দোকানে হাজির করছেন। দিনের পর দিন এক্সপেরিমেন্ট করে করে পারফেকশনে পৌঁছেছেন বিজয়। এই ক্রমাগত নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে যাওয়াটাই ওর ইউএসপি।

দু একজনকে টেস্ট করতে দিয়েছিলেন প্রথম প্রথম। কাস্টমর অ্যাকুইজিশন হয়েছে ওয়ার্ড অব মাউথ প্রক্রিয়ায়। লোকমুখে শুনেই লোক এসেছে ওর দোকানে।

মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়েছে নাম। আশে পাশের অফিস, কলেজ তো বটেই বহুদূর হেঁটে এসে চারু মার্কেটের কাছে এক কাপ চা-ই এখন চাইছে জেন ওয়াই। শুধু তরুণ প্রজন্ম বললে ভুল হবে, চাতক পাখির মতো ওর অভিনব চায়ের দোকানে লাইন দিচ্ছেন সিনিয়র সিটিজেনরাও। সকাল থেকে লম্বা লাইন। সারাদিন গম গম করে। চায়ের দাম ৫ টাকা থেকে শুরু খুব বেশি হলে ৫০ টাকায় পাবেন সব থেকে দামি চা। এই চায়ের স্টলের ট্র্যাকশন শুনলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে। দিনে কয়েক হাজার মানুষ রোজ চা খেতে আসেন ওর এই চায়ের ঠেকে। বিজয় বলছিলেন আসলে ও চায়ের কাফে কালচারটাকেই ডিসরাপ্ট করতে চান। চান চায়ের ঠেকে আড্ডাটা ফুটপাথ থেকে চার দেওয়ালের অন্তরালে যেন না চলে যায়। স্বাদ আর গুণগত মান নিয়ে সমঝোতা না করলে আড্ডাটা ফুটপাথেও জমে যেতে পারে। ফুটপাথের এই চায়ের দোকানেই। তবে আরও বিস্তৃত হতে চান। একা সামাল দিতে পারাটা সমস্যার। তাই লোক রাখছেন। বিজয় চান আরও মানুষ ওর এক্সপেরিমেন্ট করা চায়ের স্বাদ নিক। গোটা শহরে তৃপ্তির শাখা খুলতে চান। ফ্র্যাঞ্জাইজি মডেল নিয়েও দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলেন। একই রেসিপিতে সব চায়ের দোকান চলবে বলে স্বপ্ন দেখছেন বিজয়। ইতিমধ্যেই চায়ের ভাঁড় বদলে রুচিশীল মাটির কুল্হরে চা দিচ্ছেন। একটু একটু করে এক্সপেরিয়েন্স বিক্রি করা শিখে নিয়েছেন। টের পেয়েছেন চায়ের দাম শুধু চা তৈরির সামগ্রীর ওপর ধার্য করা চলে না। এক্সপেরিয়েন্স বা অভিজ্ঞতাটারও একটা মূল্য আছে। এবং ক্যাফেতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাটাই চড়া দামে কেনেন সাধারণ ক্রেতা। সেই স্বপ্নটা দেখতে শুরুও করে দিয়েছেন এই চাওয়ালা। বড় স্বপ্ন। যেখানে ক্রেতারা এসে বসে বই পড়তে পড়তে চায়ের কাপে চুমুক দেবেন। একটু আধটু নিরিবিলিও পাবেন। ল্যাপটপ খুলে কাজ করতে করতে একটু চা চেখে দেখবেন বাবুরা। বসে আড্ডা দেওয়ার দারুণ পরিবেশ থাকবে। জায়গা দেখাও হয়ে গিয়েছে। একটু একটু করে সেই জায়গা সাজানোর কাজ চলছে।

তাই বলছিলাম রবীন্দ্র সরোবর মেট্রোর স্টেশনের ৬ নম্বর গেটের সামনে ভবানী সিনেমার ঠিক উল্টো দিকে এই টি-স্টলে এলে আপনি নিজে চোখেই দেখতে পাবেন একটা স্বপ্ন অঙ্কুরিত হলে কেমন দেখতে লাগে।