#MakeinIndia-র সিংহ ইতিহাসের স্বদেশি 'সুলেখা'

#MakeinIndia-র সিংহ ইতিহাসের স্বদেশি 'সুলেখা'

Wednesday April 06, 2016,

3 min Read

‘সুলেখা’ নামটা শুনলেই মনে পড়ে দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের অদূরে একটি রাস্তার মোড়। একটা আস্ত এলাকা। শহরের আর পাঁচটা ব্যস্ত গলির থেকে আলাদা করা দায় এই এলাকাকে। জানেন তো, এই এলাকারই পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। উত্থান, পতন, সাফল্য, ব্যর্থতার কাহিনি দিয়ে বোনা একটি নাম দীর্ঘদিন ধরে এই বাংলার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। এই নাম আজ ব্র্যান্ড। শুরু হয়েছিল ইংরেজ আমলে। সেইসময় থেকেই সুলেখা জাগ্রত কিংবদন্তি। আজ কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে আমরা কথা বলব না। কথা বলব ওই ব্র্যান্ড নিয়ে। একটি বাঙালি পরিবারের ঘরোয়া ব্যবসার লড়াইয়ের কাহিনি আপনাদের বলব।

image


মহাত্মা গান্ধির সুপরামর্শের ছোঁয়া লেগে রয়েছে ‘সুলেখা’-র সৃজন রহস্যে। লেগে রয়েছে বিদেশি সামগ্রী বর্জনের স্পর্ধাও। আর আজ মেক ইন ইন্ডিয়ার আদর্শ নিদর্শন বাংলার এই সুলেখা ফ্যাক্টরি। একসময় বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল কর্মশালা। বছরের পর বছর ধরে কয়েকশো মানুষের জীবিকার বন্দোবস্ত করেছে সুলেখা। স্কুলে স্কুলে কর্মশিক্ষার কার্যক্রম চালু করে দেশের ভবিষ্যত প‌্রজন্মকে স্বনির্ভর হতেও শিখিয়েছে সুলেখা ওয়ার্কস। সংস্থার অশিতিপর কর্ণধার কল্যাণ কুমার মৈত্র বলছিলেন তাঁদের সেই লড়াইয়ের কাহিনি। উত্থান যেমন দেখেছে এই সংস্থা তেমনি ষড়যন্ত্রও কম দেখেনি। কিন্তু ফিনিক্স পাখির মত ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। নেতৃত্ব দিয়েছেন কল্যাণবাবুর ছেলে কৌশিক মৈত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চলে যান কানাডার অ্যালবেটায় উচ্চশিক্ষা নিতে। ফিরে এসে ধরেন হাল। নৌকো এগোয় তরতর করে। এক সময় কালি তৈরির কারখানা হিসেবেই পরিচিত ছিল সুলেখা। এখন কালি তো আছেই সঙ্গে সংযোজন হয়েছে আরও অনেক প্রোডাক্ট। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকও হয়েছে সুলেখা। কৌশিক বাবু বলছিলেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে তিনি শুধুমাত্র ব্যবসা বলতে চান না। মুনাফা লাভের থেকে অনেক বেশি শ্রমিক স্বার্থের কথাই ভেবেছে ‘সুলেখা’ আর ভেবে এসেছে দেশ গঠনের কথা। বাংলার মেরুদণ্ড তৈরি করে দিতেই চেয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। 

১৯৩৩ সালে যখন শুরু হয় তখন বিদেশি ব্যবসার প্রতিস্পর্ধায় তৈরি হয়েছিল সংস্থা। একদিকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন। সাহস দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁঁদের কালি ব্যবহার করে বলেছিলেন সুন্দর কালি। এভাবেই মাথা তুলে ছিল স্বদেশি সুলেখা। বাংলাদেশের রাজসাহি জেলায় তৈরি হয় কারখানা। পরে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে গড়ে ওঠে কোম্পানির ফ্যাক্টরি। তারপর পাকাপাকিভাবে যাদবপুরে গড়ে ওঠে সুলেখার বৃহদায়তন প্রোডাকশন ইউনিট।

অনেক চড়াই উৎরাই। অনেক মামলা মোকোদ্দমা। অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এই বাঙালি সংস্থা। আকস্মিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায় সুলেখা। কিন্তু ওই যে আগে বলেছি ফিনিক্স পাখির মত সে আবার ফিরে এসেছে। স্বদেশি সংস্থা তার আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে। পরিবারের নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সে ফিনিক্স পাখিটা আবারও আকাশের ওড়ার স্বপ্ন দেখছে। কৌশিক মৈত্রের নেতৃত্বে সুলেখা এখন ফের হৃত গৌরব ফিরে পাচ্ছে। ২০০৬ সালে শুরু হয়েছে দেখতে দেখতে সেকেন্ড ইনিংসও দশ বছর পারি দিয়ে দিল। কালি দিয়ে শুরু হলেও পরে ফাউন্টেন পেন, ইউজ এন্ড থ্রো বল পেন, ফিনাইল, হ্যান্ড ওয়াস, আঠা শুধু তাই নয় পরিবশ বন্ধু সামগ্রীই তৈরি করে এই সংস্থা। সৌরবিদ্যুৎ চালিত লন্ঠন তৈরি করা হয়। শুধু কি তাই বেশ কয়েকটি পেট্রোল পাম্পে সম্পূর্ণভাবে সৌরবিদ্যুত চালিত করার প্রকল্পও সফল ভাবে করেছে এই সংস্থা।

শুধু বাংলা নয় বাংলার বাইরেও বিশাল বাজার তৈরি করে ফেলেছেন কৌশিক। অসমে, ত্রিপুরায় যেমন তেমনি পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড ওড়িশাতেও সুলেখা এখন পরিচিত ব্র্যান্ড। তাঁর এই সামগ্রীর প্রধান ক্রেতারা যেহেতু মধ্যবিত্ত শ্রেনির মানুষ। তাই প্রতিটি প্রোডাক্টের দামও রাখা হয়েছে সাধারণের নাগালের মধ্যেই। রাজ্যের প্রায় ৩১হাজার রেশন দোকানে পাওয়া যায় সুলেখার বিভিন্ন প্রোডাক্ট।

সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথাটা কৌশিকদের মনে করিয়ে দিতে হয় না। ওরা নিজেদের বাণিজ্যিক লাভ ক্ষতির হিসেবটা মানবিকতার নজর দিয়ে দেখেন। কর্মীদের ছেলে ও মেয়েদের বই আর অ্যাডমিশন ফি দিয়ে থাকেন। বয়স পেরিয়ে গেলেও কাজ করেন অনেক কর্মচারী। শুধু ব্যবসা আর মুনাফা লাভ নয় কাজের মধ্যে দিয়ে বড় পরিবারের সদস্য সুলেখার কর্মচারীরা। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়েও কাজ করে ‘সুলেখা’। শিশু এবং মহিলাদের বিকাশের ভিতর দিয়েই সমাজের ভবিষ্যৎ সুলিখিত হবে বলে মনে করেন কৌশিক মৈত্র আর তাঁর বৈপ্লবিক এই ভেঞ্চার।