'নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের শহর' হয়ে যাবে City of Joy কলকাতা!

'নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের শহর' হয়ে যাবে City of Joy কলকাতা!

Wednesday February 10, 2016,

4 min Read

২০০১ সাল থেকে এই সময় অবধি কলকাতার ৭৮ হাজার বাসিন্দা ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছেন। দেশের দক্ষিণের রাজ্যগুলি-সহ সারা দেশের নানান রাজ্যে কাজের খোঁজে শহর ছাড়ছেন কলকাতার বাসিন্দারা। তাঁদের ভিতর উল্লেখ‌‌ করার মতো শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বেকার ছেলেমেয়ে রয়েছেন। কেননা, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে হাজার হাজার শিক্ষিত ছেলেমেয়ে যোগ্যতা মতো কাজ পাচ্ছেন না। এই পরিস্থি্তিতে রাজ্যের ধীশক্তিসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা অন্যত্র পাড়ি দেওয়ায় আখেরে কলকাতারই ক্ষতি হচ্ছে। কী সেই ক্ষতি তা নিয়ে গবেষণা করেছেন এক বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী। 

২০১৪-২০১৫ সালের রতন টাটা ফেলো সমাজবিজ্ঞানী শাশ্বত ঘোষের এই গবেষণা আর একটি উদ্বেগজনক তথ্যও জানাচ্ছে। ‌সেটি হল, আগামী‌ ২০ বছরের ভিতর কলকাতা শহরে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা অনেকটাই কমতে চলেছে। বয়স্ক বা আরও বেশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এর ফলে অবধারিত ভাবে কিছু বিপদ ঘটতে পারে। প্রথম বিপদ, নিরাপত্তাহীনতা। ২০ বছর পরের কলকাতা শহরের বাসিন্দা বয়স্ক মানুষজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন বলে আশঙ্কা। কারণ, পরিবারের সমর্থ ছেলেমেয়েদের ভি‌তর রাজ্য ছাড়ার হিড়িক বেড়েছে।

image


এই পরিস্থিতির কারণ আধুনিক এই সময়ে বাবা ও মায়েদের মানসিকতা। কীভাবে সন্তানকে বড় করে তুলবেন, তা নিয়ে বাবা ও মায়েদের ভিতরকার প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা ক্ষতি করছে সমাজেরই। শাশ্বত ঘোষ গবেষণাটি করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইক্সনমিক্সে। শাশ্বত বললেন, আমার সন্তানই একমাত্র থাকুক দুধেভাতে। এই দুরাশা আর সন্তানের কেরিয়ার নিয়ে বাবা-মায়েদের আকাশচুম্বী পরিকল্পনা গত চার দশক ধরে কলকাতা শহরের জন্মহার কমিয়েছে। দম্পতি পিছু একটি বা দেড়টি সন্তান। তাঁদের ঘিরে বিরাট এক আশার কাহিনি বুনছেন বাবা-মায়েরা। কখনও কখ‌নও ওই স্বপ্ন অবাস্তবও।

আসলে দুটির বেশি সন্তান হলে তাকে প্রতিপালন করাটা শক্ত ছিল না বাঙালি দম্পতির পক্ষে। পঞ্চাশের দশকেও বহু পরিবারে আট-নয়জন ভাইবোন হরদম দেখা ‌গিয়েছে। ও ছিল একটা নিতান্ত সাধারণ ঘটনা। এমন বহু পরিবারের ছেলেমেয়েরা পরে জী‌বনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ওঁদের কেউ কেউ সমাজে নানান অবদানের কারণে সম্মানীত মানুষ হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। সেদিনের বাবা-মায়ের মানসিক গড়নের সঙ্গে একালের বাবা-মায়েদের মনের গড়নটা একেবারেই আলাদা। শাশ্বত জানালেন, ৭০ দশকের পরেই মানুষ ক্রমে একাকী হতে চাইছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলি ভেঙে গিয়েছে। শরিকি ঝামেলাও বেড়েছে। ফলে, বাড়ি ভাঙছে।

স্বামী-স্ত্রীর খুব ছোট সংসারে ‌যে বাচ্চাটিকে জন্মগ্রহণ করানো হবে, তাঁকে ঘিরে বাবা-মায়ের স্বপ্ন থাকাই স্বাভাবিক। তবে, এক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে বাচ্চাকে ঘিরে বাবা ও মা জাগতিক সাফল্যের স্বপ্ন দেখাতে। বলাবাহুল্য এভাবে শিশুটি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে।

শাশ্বত জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করেন। বললেন, এখনই তো ফাঁকা বাড়িতে বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সল্টলেকে তো এমন বাড়ি অনেকই আছে। কিছু ক্ষেত্রে ফাঁকা বাড়িতে থাকা বয়স্ক মানুষজনের ওপর চলছে দুষ্কৃতী হামলাও। এই সমস্যাই আরও বাড়তে চলেছে বলে গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন শাশ্বত।

শুধু কলকাতা শহর নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গেরই এক হাল। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ‌‌‌হাতের কাছে কাজের সুযোগ নেই। শাশ্ব‌ত বললেন, শিল্পায়নের সাফল্য এলে এই অবস্থা কাটানো যেতে পারে। তবে, এখনই আশার আলো আছে বলে মনে করেন না শাশ্বত।

তাছাড়া, এই অসুখ, ‌যা মানুষের অবদমিত উচ্চাকাঙ্খা থেকে মানুষের ভিতর এমন এক জেদ তৈরি করেছে যে, মানুষ তাঁর সন্তানকে জন্মের কিছুদিন পরেই ঠেলে দিচ্ছেন প্রতিযোগিতার বাজারে। যেখানে শৈশব-কৈশোরেই শিশুকে শুনতে হচ্ছে, জীবন একটা দৌড়মাত্র। তোমাকে দৌড়তে হবে। আমরা বাবা-মায়েরা তোমাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। যে কোনওভাবেই হোক না কেন, তোমাকেই আমাদের দেখা স্বপ্ন সফল করতে হবে। এদিকে বাচ্চারা তো আর সকলেই ফার্স্ট বয় হতে চায় না। ফলে, তাদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শৈশব ও কৈশোর। আগামী দিনের সমাজের পক্ষে বপারটা স্বভাবতই সুখবর নয়। বরং, বিপ‌র্যয়ের সঙ্কেত।

তবে, বলাবাহুল্য এই বিপর্যয় ঠেকাতে গেলে সমাজকে আরও উন্নত হতে হবে। শাশ্বত বলেন, এর বেশিরভাগ দায় প্রতিটি মানুষের। শহরাঞ্চলের মানুষ এখন পণ্যবাদীতে পরিণত হয়েছেন। ওই সংস্কৃতি ছেড়ে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর বাবা-মায়েদের এটাও বুঝতে হবে, তাঁদের অবদমিত বা অসফল স্বপ্নের প্রত্যাশাপূরণের দায় সন্তানের নয়। এই বোধগম্যতা ‌‌একটি নাগরিক কর্তব্য। এ দায়িত্ব পালন না করলে বার্ধক্যের বারাণসীতে বিপদে পড়তে হবে।

ওই বিপদ একলা বাড়িতে একাকী থাকা। কেননা, এই রাজ্যের বহু ভাল ছেলেমেয়ে এখনই প্রবাসী বা অনাবাসী। সেখানেই তাঁদের একটা বড় অংশ থিতু হয়ে গিয়েছেন। অনেকে বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্বও নিয়েছেন। এদিকে বাবা-মায়েরা অনেকেই অসুস্থ এবং একা। প্রবাস থেকে ছেলেমেয়েরা তো আর যখন-তখন ছুটে আসতে পারবেন না। অনেকে বছরের পর বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে ইতিমধ্যে মারাও গিয়েছেন।

প্রতিষেধক বলতে এটাই, কাজের ক্ষেত্র বা পরিকাঠামো রচনা করার সরকারি দায়িত্ব। অন্যদিকে, বুঝতে হবে ভবিষ্যত জীবনগুলিকেও। এছাড়া, আর কোনও পথ নেই বলে জানালেন শাশ্বত।

আরও পড়ুন

ভারজিন ভেলেন্টাইন-নিঃসঙ্গ প্রবীনদের জন্য ‘প্রতিমুখ’এর প্রয়াস। তৈরি হচ্ছে ফিল্ম। বাংলায় এবং ইংরেজিতে।