কলকাতায় রানী ভবানীর Treasures of Innocence
সেভ দ্য চিলড্রেন হোম। ঠিকানা কলকাতার ঠাকুরপুকুর। সেখানেই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী এগারো বছরের রাবেয়া। তার বয়সি আর পাঁচজন ছেলেমেয়ের মতো সেও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। চারপাশের প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু তার জীবনে সেটা ঘটেছে Treasure of Innocence আসার পরেই। রাবেয়ার কথায়, " স্কুল,পড়াশোনা, বন্ধুদের নিয়ে হইচই করেই জীবন কাটছিল। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়ই ছিল না। এমন সময়েই যোগ দিলাম Treasure of Innocence (ToI)-এর Ignited Minds প্রোগ্যামে। তখন থেকে জীবন সম্পর্কে ধারণাই বদলে গেল। এখন আমি নিজেকে ও চারপাশের পরিবেশকে নিয়ে ভাবি। শিক্ষা, ভালো ব্যবহার, অন্যকে সম্মান ও সাহায্য করা এ সবের গুরুত্ব আমি শিখেছি। সবচেয়ে বড় কথা পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা। এই পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমি সবসময় জানার চেষ্টা করি। এ সবের ফলে আমার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গিয়েছে।"
রাবেয়ার মতোই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মিতা কর্মকার। তবে সে পড়ে কাশীপুর ইনস্টিটিউশন ফর গার্লসে। শিশুদের জন্য একটি ছবিতে গল্পের বইয়ের অন্যতম লেখক এই মিতা। এত কম বয়সে বই লেখা সম্ভব হল কী করে? মিতার মুখ থেকেই জানা গেল ব্যাপারটা।" Treasure of Innocence (ToI)-এর My Book My World প্রোগ্যামে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের ছবি-সহ গল্প লিখতে বলা হয়েছিল। আগে এমন কোনও অভিজ্ঞতা না থাকায় আমরা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ToI-এর সদস্যরা আমাদের নিরন্তর উৎসাহিত করতে লাগল। শেষপর্যন্ত আমরা ছবি-সহ একটা পুরো গল্প লিখে ফেলতে পারলাম। তবে ছবিগুলো ভালো হয়নি। আমাদের নিজেদেরই সেগুলো ভালো লাগছিল না। এবারও সদস্যরা এগিয়ে আসেন এবং আমাদের ছবি আঁকার ব্যাপারে সাহায্য করেন। শেষপর্যন্ত বইটা হল। সেখানেও একটা আশঙ্কা কাজ করছিল। কী জানি লোকজন কী বলবে। কিন্তু পরে বুঝলাম মিলেমিশে কিছু করা ও সেরাটা দেওয়ার চেষ্টাই আসল কথা। এখন তাই আমি গর্বিত। এটা ভাবতেই ভালো লাগে যে একটা নতুন স্টোরি বুক লিখে ফেলা দলের আমিও সদস্য", বলল মিতা।
শিশুদের মনের বিকাশ ঘটানো, তাদের স্বপ্ন দেখতে শেখানো, তাদের কৌতূহল ও সৃজনশীলতাকে উসকে দেওয়া। এ সব নিয়েই কাজ করে থাকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা Treasures of Innocence (ToI). নন-প্রফিট এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা রানি ভবানী বললেন," পড়াশোনা যে একটা আনন্দদায়ক বিষয়, সেটা সব শিশুর কাছে তুলে ধরা হয় না। শিক্ষাদান মানেই যেন কঠোর অনুশাসন আর ভয়ের ব্যাপার। শিশুরা সেখানে নিজেদের খুঁজেই পায় না। ভাষার ব্যবহার, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও তার প্রয়োগ শেখান হয় না। ফলে যে সব ছাত্রছাত্রী উচ্চমানের শিক্ষালাভ করে তাদের মুখোমুখি হতে এইসব ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। তারা হীনমন্যতায় ভোগে। সহজেই হার স্বীকার করে নেয় আর হতাশার চাদরে মুখ ঢেকে নেয়। ভয়ানক এই চক্রটা আজও থেমে নেই।" কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও MBA ডিগ্রিধারী রানির Project Management ও Consulting-এ বহুমুখী অভিজ্ঞতা রয়েছে। উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রযুক্তির ব্যবহারে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করেছে রানি। বাচ্চাদের জন্য সোশ্যাল রেসপন্সবিলিটি প্রোগ্যামও তৈরি করেছে সে। কোনও প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, সরাসরি যুক্ত থাকাটাই রানির কাজের বিশেষত্ব।
অল্পবয়স থেকেই দরিদ্র শিশুদের নিয়ে নানারকম কাজের সঙ্গে যুক্ত রানি। সেই সব কাজে শিশুদের সৃজনশীলতাকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না, রানি এটা লক্ষ্য করেন। সম্ভবত এটাই পরবর্তীকালে Treasure of Innocence (ToI) গড়ে তোলার বীজ বপন করেছিল তার মনে।"আমার ঠাকুরমা বেলুড় মঠের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিশু ও গ্রাম্য মহিলাদের উন্নতিতে বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজে যোগ দিতেন তিনি। তার সঙ্গে আমিও যেতাম। সেটা আমাকেও উৎসাহ জোগাত। এরপর পড়াশোনা, মাস্টার্স ডিগ্রি, কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি। ২০১৩ সালে Treasures of Innocence গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে স্বপ্নটা বহুদিন মনের মধ্যেই ছিল। আমি একা হাতেই দিনরাত জেগে ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে উঠেপড়ে লাগলাম। শেষপর্যন্ত চাকরি ছাড়ারও সিদ্ধান্ত নিলাম। যাতে শিশুদের উন্নয়নে আরও বেশি সময় দিয়ে স্বপ্নকে সত্যি করতে পারি", বললেন রানি।
Treasures of Innocence থেকে উপকৃত হয়েছে সাধারণ ঘরের বহু ছাত্রছাত্রী।এমনই একজন নবজাতক বিদ্যাভবন ফর গার্লসের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ১৩ বছরের অঞ্জুরা খাতুন।Ignited Minds প্রোগ্যামে যোগ দিয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছে অঞ্জুরা। চারপাশের প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, সম্পর্ক সবকিছুকেই এখন অন্য ভাবে দেখে সে। যে কোনও বিষয় সম্পর্কে জানার ইচ্ছা তার বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। ঠিক এমনই পিছিয়ে পড়া, অনাথ ছাত্রছাত্রীদের বিকাশে কাজ করে চলেছে Treasures of Innocence. শুধু শহর নয়, কর্মকাণ্ড গ্রামেও। অল্পবয়সিদের মধ্যে যে সহজাত সৃষ্টিশীলতা রয়েছে তা বের করার ওপরই জোর দেওয়া হয়ে থাকে। এ জন্য ধ্যান, গ্রুপ ডিসকাশন, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, ভিডিও, গল্প বলা, ছবি আঁকা, নাটক, বিজ্ঞানমুখী পরীক্ষায় জোর দেওয়া হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রানি বললেন,"চলতি শিক্ষাদান পদ্ধতিতে অন্যতম খারাপ দিক হল যে এটা কোনও কিছু নিয়ে ভাবতে শেখায় না। ফলে সেই শিক্ষা শিশুরা ক্রিয়েটিভ কাজে লাগাতে পারে না।কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, প্রয়োগ এগুলোই হল মূল ব্যাপার। এই শূন্যস্থান পূরণ করতে আমরা মেনে চলি TIAL (Think>Ideate>Act>Lead) ফ্রেমওয়ার্ক।"
২০১৩ সালের জুনে আত্মপ্রকাশ হয়েছিল Treasures of Innocence-এর। মাঝের এই দুই বছরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে সংস্থা। স্বামী বিবেকানন্দর দেখানো পথেই নিস্পাপ শিশুদের মনের বিকাশ ঘটানোর কাজে লেগে রয়েছেন রানি। মনুষ্যত্বের পূর্ণতার সেই পথে শিশুদেরকেই বেছে নিয়েছে ToI. সেইসব শিশু যাদের কেউ নেই। যাদের বড় হয়ে ওঠা রাস্তায়, যাদের খাদ্যের সংস্থান নিজেদেরই করতে হয়, যাদের ভালোবাসার কেউ নেই। তবে সব শিশুর মধ্যেই একটা মিল রয়েছে। কৌতূহলী একটা মন। যে এই জগৎকে জানতে চায়। সেই জানানোর কাজটাই করে চলেছেন রানি। বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়, অনাথ আশ্রমে ক্লাসের ব্যবস্থা করেন তারা। সেখানেই হাজির হয় পড়ুয়ারা।