খিদিরপুরের যৌনপল্লি থেকে আলোয় ফেরার রাস্তা চেনান মহুয়া
বছর বত্রিশের জয়িতা (নাম পরিবর্তিত) একসময় কলকাতার মুনশিগঞ্জ যৌনপল্লিতে সাত বছর দেহ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এই পেশা কখনই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে জয়িতা যোগ দেন ডিভাইন স্ক্রিপ্টে। সেখানে হাতের কাজ শেখান হোত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা রপ্ত করে নেন জয়িতা। দেড় বছর সেখানে কাজ শেখার পরে জয়িতা একটা চামড়ার কারখানায় পূর্ণ সময়ের কাজও পেয়ে যান। দেহ ব্যবসা থেকে যে টাকা পেতেন এখানে বেতন তার থেকে বেশি। জয়িতা এখন তাই যৌনপল্লিতে থাকেন না। সমাজে আর পাঁচজনের মতোই মাথা উঁচু করে বাঁচছেন জয়িতা।
জয়িতার মতোই ২৮ বছরের ফরজানা (নাম পরিবর্তিত) একটা যৌনপল্লিতে ১২ বছর যুক্ত ছিলেন। মুনশিগঞ্জে তাকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে আসে এক দালাল। খুব খারাপ ভাবেই কাটছিল জীবন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে জীবন বদলে গেল। একজন শুভাকাঙ্খী তাকে পাঠালেন ডিভাইন স্ক্রিপ্টে। তিন মাসের মধ্যেই মিলে গেল একটা দেখভালের কাজ। সারাদিনের কাজ হলেও বেতন বেশ ভালো। অন্তত দেহব্যবসার থেকে অনেকটাই বেশি। ফরজানাও তাই দেহ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে নতুন ভাবে বাঁচছেন।
জয়িতা এবং ফরজানার মতোই ডিভাইন স্ক্রিপ্টের হাত ধরে খিদিরপুরের যৌনপল্লি থেকে নতুন জীবনে পা রেখেছেন অনেকে। বাঁচার নতুন মানে খুঁজে পেয়েছেন তারা। এই ধরনের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের নিয়েই কাজ করে থাকে মহুয়া সুর রায় প্রতিষ্ঠিত এনজিও ডিভাইন স্ক্রিপ্ট। সামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছেন মহুয়া। যৌন পেশায় যুক্ত অসহায় মহিলাদের কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী বিকল্প পথ দেখান যায়, সেটাই ছিল মহুয়ার লক্ষ্য। মহুয়ার কথায়, "ডিভাইন স্ক্রিপ্ট শুরুর আগেও, আমার কর্মজীবনের শুরু থেকেই সামাজিক উন্নয়নে দুটো বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা বারবার উপলব্ধি করেছি। কার্যকারিতা এবং স্থায়িত্ব। এমনকী একটি নামি NGO-তে Deputy Director পদে কাজ করার সময়ও দেখেছি, যৌনপেশায় যুক্ত মহিলাদের পাশে দাঁড়াতে যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল তাতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছিল না। যৌনকর্মীদের দুর্দশার কোনও পরিবর্তনই তাতে হচ্ছিল না। এই অভিজ্ঞতা অবশ্য আমাকে পথ দেখাল। শোচনীয় অবস্থা থেকে খিদিরপুরের ওই সব কিশোরী ও মহিলাদের কীভাবে মানসিক ও আর্থিকভাবে দীর্ঘস্থায়ী বাঁচার পথ দেখান যায়, আমি ভাবতে শুরু করে দিই।"
যৌনপল্লি থেকে মহিলাদের বের করে আনলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। এটা বুঝে গিয়েছিলেন মহুয়া। তাদের বাঁচার জন্য বিকল্প রোজগারের পথ বের করতে হবে। যাতে তারা আর্থিক স্বাধীনতা নিয়ে মর্যাদার জীবন পেতে পারে। "২০১১ সাল নাগাদ আমরা ডিভাইন স্ক্রিপ্টের কাজ শুরু করি। শুরুই করেছিলাম মেয়েদের জন্য একটা হস্টেল দিয়ে। এইসব মেয়েরা যৌনপেশায় জড়িত তাদের মায়েদের সঙ্গে একই ঘরে থাকে। সেইসব মেয়েদের কথা ভেবেই ওই হস্টেল। আসলে আমরা এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনওভাবেই যেন কিশোরী মেয়েরা দেহ ব্যবসার শিকার না হয়।পরবর্তী সময়ে আমরা তৈরি করলাম একটা প্রোডাকশন ইউনিট। সাইকেলের টায়ার-টিউব রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে তৈরি জিনিস এখানে রাখা হোত। পাশাপাশি ওইসব জিনিস রফতানি করে প্রান্তিক এইসব মেয়েদের বেঁচে থাকার একটা বিকল্প পথ বের করতে পেরেছিলাম", বললেন মহুয়া।
মা যে কোনও কারনেই হোক যৌনপেশায় জড়িত, কিন্তু তাদের মেয়েদের জীবনে তা হতে দেওয়া যাবে না। এমন ১৮ বছরের বেশি বয়সি মেয়েদের সম্মানজনক বিকল্পের সন্ধান দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন মহুয়া। অর্থনীতিতে এমএ মহুয়া ২০ বছরের বেশি সময় ধরে শিশু স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে যৌনস্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেছেন। সেফ শেল্টার কেন? মহুয়া বলেন," এইসব মেয়েদের অধিকাংশ রাতে মায়ের সঙ্গে থাকে। ফলে পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়। সেজন্যই হস্টেল। পাশাপাশি যৌনকর্মীদের অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের স্পনশর্ড প্রোগ্যামের মাধ্যমে বিভিন্ন আবাসিক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে তারা উপযুক্ত শিক্ষা, খাদ্য ও পরিবেশ পায় মানুষ হয়ে ওঠার জন্য। ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকে। কোর্স শেষ হওয়ার পরে তারা মূলধারার কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। যাতে সেই রোজগারের টাকায় সেই ছেলেটি বা মেয়েটি তার মা'কে দেহ ব্যবসা থেকে বের করে আনতে পারে। আমাদের একটা প্রোডাকশন ইউনিটও রয়েছে। যেখানে রেডলাইট এরিয়া ও পিছিয়ে পড়া এলাকার মেয়েরা দুই শিফটে কাজ করে থাকে।"
বিষয়টা আরও ব্যাখ্যা করে মহুয়া বলেন, "আমাদের এই উদ্যোগের ফলে যৌনকর্মীরা রাতারাতি তাদের মূল পেশা ছে়ড়ে দেবে, এমনটা আমরা দাবি করি না। কিন্তু আমাদের প্রোডাকশন ইউনিটের কাজ তাদের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে সাহায্য তো করবে। অন্যদের সঙ্গে মেশামেশার ফলে বাইরের জগতে তাদের কাজ পেতেও সুবিধা হবে। ইন্টারপারশোন্যাল কমিউনিকেশনের যে ট্রেনিং দেওয়া হয় তার ফলে তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ছে। আমরা যে সব জিনিস তৈরি করি তা সাধারণত রফতানি করা হয় এবং Amazon.in কিংবা Paytm-এ তা লিস্টেড। আমরা আরও বেশি-বেশি করে অন্য দেশেও এইসব জিনিস রফতানি করতে চাই। যাতে সেই টাকায় আরও বেশি সংখ্যক মেয়েকে আমরা সুস্থ ভাবে বাঁচার পথ দেখাতে পারি।"
ডিভাইন স্ক্রিপ্টের সবথেকে ভালো দিক হল রেডলাইট এরিয়া থেকে আসা মহিলা ও মেয়েদের মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখে না। সবাইকে একইরকম নিয়মানুবর্তিতা, কর্মমুখী দৃষ্টিভঙ্গী ও পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হয়। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে তাদের আত্মমর্যাদা বাড়ে।
মহুয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। খিদিরপুরের ওই অঞ্চলের যে সব মহিলা ডিভাইন স্ক্রিপ্টে যোগ দিয়েছেন তাদের জীবন বদলে গিয়েছে। অন্ধকার থেকে আলোর নিশানা খুঁজে পেয়েছেন তারা। গত চার বছরে ১৪ জন কিশোরীকে হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছে ডিভাইন। sponsorship programmes-এর মাধ্যমে ১১ জন অল্পবয়সি ছেলেমেয়েকে বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে। প্রোডাকশন ইউনিটে বর্তমানে কাজ করছেন ৩২-৩৫ জন মহিলা। আর এ সবের নির্যাস হল গত চার বছরে ৬ জন মেয়ে সমাজের মূল স্রোতে নিজেদের অধিকারে জায়গা করে নিয়েছেন। আর বাকিরা? সেই লড়াই থেমে নেই।