“রবীন্দ্রনাথের মধু, বিধুকে মনে আছে? আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি/ পুজোর সময় এলো কাছে,/ মধু বিধু দুই ভাই ছোটাছুটি করে তাই/ আনন্দে দুহাত তুলি নাচে, মধু বিধুর গরীব বাপ শুধু ছিটের জামা, ধুতি, চাদর এনে দিতে পেরেছিল ছেলেদের, কিন্তু ভেবে দেখুন তো এই আমাদের শহরেই কত মধু বিধু রয়েছে যাদের সেটুকুও জোটে না, মলিন মুখে খালি গায়ে মণ্ডপের পিছনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যাদের, আর মণ্ডপের সামনেটা বরাদ্দ থাকে রায় বাবুদের গুপীদের জন্য, এই বৈষম্যটা ভাবিয়ে তুলছিল আমাদের, খারাপ লাগত। সেখান থেকেই ভাবনা শুরু আগমনীর”, বললেন সংস্থার সেক্রেটারি শতদীপ কোলে।
গত পাঁচ বছর ধরে পুজোর আগে পথ-শিশুদের নতুন জামা ও একটুকরো খুশি তুলে দেওয়ার কাজটা করে আসছে আগমনী। শতদীপ একটি বহুজাতিক সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করেন। ছাত্রজীবন কেটেছে রামকৃষ্ণ মিশন (রহড়া)-র হোস্টেলে, সেখানেই বন্ধুত্ব, সংস্থার আরেক প্রতিষ্ঠাতা অয়ন বসাকের সঙ্গে। অয়ন পেশায় চিকিৎসক। দুই বন্ধু মিলেই প্রথম ভাবনা শুরু। পথ-শিশুদেরও পুজোর আনন্দে সামিল করা, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। সংস্থার আরও এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অসীম রায় চৌধুরী, দীর্ঘদিন ধরে নানা সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত তিনি। শতদীপ ও অয়ন নিজেদের এই পরিকল্পনা ভাগ করে নেন ব্যাচের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে, জুটে যায় আরও কয়েকজন- সপ্তর্ষি ঘোষ, শুভঙ্কর জানা, শান্তনু ঘোষ, সপ্তর্ষি সরকার ও তথাগত দাস. যাত্রা শুরু হয় ২০১১ এর অগাস্টে. কেউ অনুদান সংগ্রহের কাজ করেন তো কেউ কাজ করেন সরাসরি মাঠে নেমে. প্রথম বছর ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের থেকে অনুদান সংগ্রহ করে কাজ শুরু করেন শতদীপরা, ওঠে ২৫,০০০ টাকা। সেই থেকে প্রতিবছরই পুজোর মুখে বেরিয়ে পরেন আগমনীর স্বেচ্ছাসেবীদের দল, নতুন জামা তুলে দেওয়া হয় ফুটপাথ-বাসী শিশুদের হাতে। নাগের বাজার, দমদম স্টেশন, বাগবাজার, মৌলালী, পার্কসার্কাস, রাসবিহারী, চেতলা, দেশপ্রিয় পার্ক ইত্যাদি শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শিশুদের দেওয়া হয় জামা। এছাড়া রহড়া, বেলুড় ও ঝাড়খণ্ডের জামতারাতেও বস্ত্র বিতরণ করে সংস্থাটি।
“জামাগুলো পাওয়ার পর বাচ্চাগুলোর মুখে এক অনাবিল হাসি দেখতে পাই, ওরা তো আসলে ভাবতেই পারত না পুজোতে ওদেরও নতুন জামা হতে পারে, ওদের ওই খুশিটুকুই আমাদের পাওনা,” বললেন শতদীপ।
প্রথম বছর পথ-শিশুদের জামা দিতে গিয়েই শতদীপরা আরও একটি প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, এইসব গৃহহীন মানুষ, বিশেষত বৃ্দ্ধ ও শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রয়োজন খাদ্য। সেই বছর থেকেই তাদের কাছে মুড়ি, চিড়ে, কেক, বিস্কুটের মতো শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় আগমনী।
২০১৪ এ আরও একটি উদ্যোগকে নিজেদের সঙ্গে সামিল করে নেয় আগমনী। প্রকল্পের নাম সৌম্য ফাউন্ডেশন। প্রয়াত সৌম্যদীপ রায়ের নাম অনুসারে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য দরিদ্র মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দেওয়া। আগে এটি একটি পৃথক সংস্থা ছিল, সৌম্যদীপের ২৬ তম জন্মদিন, ৬ জানুয়ারি, ২০১৩ তে এই প্রচেষ্টাকে আগমনীর সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া হয়।
গতবছরই আরও একটি উদ্যোগ শুরু করে এই সংস্থা, শিশুবিকাশ ও যত্ন উদ্যোগ। লক্ষ্য, শিশুদের সার্বিক বিকাশ। প্রকল্পের দুটি ভাগ, জীবনের জন্য শিক্ষা এবং আনন্দ দিবস ও অঙ্কন প্রতিযোগিতা। আয়লা বিধ্বস্ত হিঙ্গলগঞ্জ সংলগ্ন এলাকার চারটি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক ও জুনিয়র বেসিকের ছাত্রছাত্রীদের সারাবছরের পড়াশোনা সামগ্রী যেমন বই, খাতা, পেন, পেনসিল, পেনসিল ব্যাগ, রবার, মানচিত্র, গ্লোব ইত্যাদি দেওয়া হয় জীবনের জন্য শিক্ষা প্রকল্পে। মোট ১২০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়। শিশুদের গতানুগতিক দৈনন্দিন জীবনের বাইরে একটি হাসিখুশি দিন উপহার দেওয়ার জন্য রয়েছে আনন্দ দিবস ও অঙ্কন প্রতিযোগিতা। অঙ্কন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি থাকে খেলাধুলো, কেক, চকোলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী।
ভবিষ্যতে আরও স্কুলকে এই প্রকল্পের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও উচ্চশিক্ষাতেও যাতে একই রকম সাহায্য করা যায় ও প্রয়োজনীয় টিউশন ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায় সেবিষয়ও ভাবনাচিন্তা চলছে।
বর্তমানে এই সংস্থার সঙ্গে রয়েছেন প্রায় ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবী। পুরো সংস্থাটিই চলে স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা। শতদীপ জানালেন, “আমাদের সংস্থায় কোনও কর্মভেদ বা যাজকতন্ত্র নেই। সংস্থার প্রতিটি সদস্যের মতামতকেই একইরকম গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংস্থার পরিচালনা ও নতুন স্বেচ্ছাসেবীদের পরামর্শদানের জন্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের নিয়ে তৈরি হয়েছে পরিচালন সমিতি। সংস্থার প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে নবীনতম সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত, গৃহহীন, প্রান্তিক মানুষদের সার্বিক উন্নয়নই একমাত্র লক্ষ্য”।
পরিচিত, বন্ধুবান্ধব, চেনা পরিজনের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকেও ব্যবহার করা হয় অনুদান সংগ্রহের জন্য।
“নেশা এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটা বড় সমস্যা। জীবনের নানা স্বাভাবিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত এই শিশুরা খুব সহজেই নেশার কবলে পড়ে, তাই স্কুলগুলিতে নেশার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ক্যাম্প করার পরিকল্পনা রয়েছে,” জানালেন শতদীপ।