অদিতির জীবন যেন সাপ লুডো খেলা,উত্তরণের সিঁড়িই লক্ষ্য
সমাজের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সাফল্যের এক নাম অদিতি চৌরাসিয়া। খুবই ছোট শহরের এই মেয়েটি আজ ‘ইঞ্জিনিয়ারবাবুর’ সহপ্রতিষ্ঠাতা। ‘ইঞ্জিনিয়ারবাবু’ সমস্ত ধরনের আইটি সার্ভিস দেয়। অদিতির জীবনে অনুপ্রেরনা আব্দুল কালামের বই ‘উইংস অফ ফায়ার’ এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাসের গল্প।
‘তুমি এটা করতে পারবে না, কারণ তুমি একজন মেয়ে।’ যেদিন থেকে এই কথাটা শুনেছিলেন, সেদিন থেকেই আরো বেশি করে নিজের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন অদিতি চৌরাসিয়া। খুবই ছোট শহরের এই মেয়েটি আজ ‘ইঞ্জিনিয়ারবাবুর’ সহপ্রতিষ্ঠাতা। ‘ইঞ্জিনিয়ারবাবু’ সমস্ত ধরনের আইটি সার্ভিস দেয়। কোনও ডিজাইন থেকে শুরু করে সেটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা সবই তাঁরা করে থাকেন। এছাড়াও ‘অ্যান্ড্রোয়েড’, ‘আইওএস অ্যাপ’-এর উন্নতি, ওয়েব ডিজাইন-সব ধরনের কাজ করেন এঁরা।
ভাবলে অবাক হতে হয়, যে কাজগুলি তিনি করতে পারবেন না বলে লোকের কাছে কথা শুনতে হয়েছিল, সেই কাজগুলিই যেন তাঁকে আরও বেশি করে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিল। খাজুরাহোর পাশে গরহি মালেহারায় জন্ম অদিতির। এই শহরে মহিলাদের নিজস্ব কোনও পরিচিতি বলে কিছুই ছিল না। সমাজের নিষ্পেষণে অস্থির হয়ে গিয়েছিল এঁরা। এ রকম একটা পরিবেশে জন্ম নিলেও অদিতির স্বপ্ন দেখার কোনও শেষ ছিল না। তাঁর স্বপ্নকে আরও বেশি করে উৎসাহ দিত তাঁর ঠাকুমা। অদিতিই ছিল ওই শহরের প্রথম মেয়ে, যে কী না ১৮ কিলোমিটার দূরে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াশুনা করত। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিন। এই বয়স থেকেই তাঁকে ‘চরিত্রহীন’ বলে কটুক্তি করতো প্রতিবেশীরা। কারণ সে কোএড স্কুলে ছেলেদের সঙ্গে পড়তো।স্কুলের এক সহপাঠি প্রথম স্থান অর্জন করায় তাঁকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল অদিতি। অদিতি অভিনন্দন জানাতে গিয়ে ওই সহপাঠিকে বলেছিল সেও প্রথম ডিভিশনে পাস করেছিল। কিন্তু প্রথমস্থান অর্জন করা আর প্রথম ডিভিশনে পাস করার মধ্যে কী পার্থক্য তা অদিতি জানতেন না। ওই মেয়েটি তাঁকে বুঝিয়ে দেন এই দু’টির পার্থক্য কোথায়। এরপর থেকেই অদিতির জীবনে আসে পরিবর্তন। অদিতি বুঝতে পারেন, মানুষের সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলে সেই মানুষ সব কিছু করতে পারেন। লোকে যখনই বলতেন, অদিতি অঙ্কে কিংবা ফিজিক্সে ভালো নয়, তখন থেকেই অদিতি অঙ্ক এবং ফিজিক্সকে ভালোবাসতে শুরু করেন।
একসময় পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন অদিতি। কিন্তু আর্থিক অবস্থা অনূকূল না হওয়ার জন্য তা সম্ভব হয়নি। একটি ভাইও ছিল তাঁর। কিন্তু শারীরিক নানা সমস্যা থাকায় সে খুব কম বয়সে মারা যায়। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন অদিতি। তারপর থেকে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে মনে জেগেছিল তাঁর। কিন্তু সেই ইচ্ছে তাঁর পূরণ হয়নি। কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দেননি অদিতি।যেন জীবনের সাপ লুডো খেলে চলেছেন।কখনও সাপের মুখে পড়ে নেমে যাচ্ছেন কখনও বা ছোট্ট সিড়ি বেয়ে উপরের উঠে যাচ্ছেন।হাল ছাড়ে নি সে। ২০০৯ সাল ইন্দোরে CAT-এর জন্য প্রস্তুতি নিতে চলে যান তিনি। সেখানেই দেখা হয় তাঁর বন্ধু ময়ঙ্কের সঙ্গে। যিনি বর্তমানে ‘ইঞ্জিনিয়ারবাবু’র আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা। স্বপ্নকে পূরণ করতে ময়ঙ্কের সাহায্য অদিতি পেয়েছেন সর্বদা। এমবিএ পড়তে পড়তেই অদিতি ২০১০ সালে শুরু করেন ভেন্ডাস সার্ভিস এবং ২০১৩ সালে তিতলিয়ান ক্রিয়েশন। কিন্তু আর দশজন মেয়েদের মতো শুরু হয় বাবা-মা’র বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া। নয়তো চাকরি খোঁজা। বাধ্য হয়ে তিতলিয়ান ক্রিয়েশন ছেড়ে ইন্দোরে একটি ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে পড়াতে শুরু করেন তিনি। সেই সময়ই অদিতি শুরু করেন ‘ইঞ্জিনিয়ারবাবু’। মাত্র দু’জন কর্মী নিয়ে। আর আজ সেখানে কর্মীসংখ্যা ৫০। সারা পৃথিবী জুড়ে ৫০০ জন ক্লায়েন্ট রয়েছে তাঁদের।
‘ইঞ্জিনিয়ারবাবু’ শুরুর প্রথম দিকে কিছুদিন কষ্ট করতে হলেও, আজ ময়ঙ্ক এবং অদিতি দু’জনেই খুশি। অদিতির ঠাকুমা তাঁকে পড়ে শোনাতেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের গল্প। অদিতির অনুপ্রেরণার শুরু সেখান থেকেই।নতুন কিছু করার তাগিদ।আবিস্কার। আব্দুল কালামের বই ‘উইংস অফ ফায়ার’ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অদিতির মতে, পরিবার কিংবা শ্বশুরবাড়ি সর্বত্র মেয়েদের দাবিয়ে করে রাখার চেষ্টা হয়। কিন্তু কোনও মহিলা যদি মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে জীবনের প্রতিটি ধাপে সে সাফল্য পাপেই পাবে এ বিশ্বাস তার আছে।