সৌমর ভোজবাজি কারখানায় তৈরি হয় জাদু বাক্স
জায়গাটা শান্তিনিকেতন। বসেছে জাদুর আসর। অতিথির আসনে বসে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ সহ আরও অনেকে। শুরু হল জাদুর খেলা ‘ইলিউশন বক্স’। একটি বড় কাঠের বাক্স। খেলা শুরুর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিলেন বাক্সটিকে।দুই হাত ও পা ভালোভাবে বেঁধে থলেতে পুরে দেওয়া হল জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীকে।থলে বন্দী গণপতিকে পোরা হল ওই বাক্সের মধ্যে। এবার বাক্সটিকে চারদিক দিয়ে বেঁধে তালা বন্ধ করে দেওয়া হল। খেল শুরু। বাক্সের সামনে ছোট্ট একটি কালো পর্দা ঝোলাতেই মুহূর্তে পর্দার উপরে দেখা দিল জাদুকরের বাঁধা দুই হাত। হাত দুটি সরে যেতেই পর্দা সরিয়ে দেখা গেল বন্ধ বাক্স। এবার বাক্সের উপর বাঁয়া তবলা রেখে কালো পর্দা ঝোলাতেই বাজতে শোনা গেল তবলার বোল। যেন সব ভূতুড়ে ব্যাপার। পর্দা সরে যেতেই আবার বাক্স পূর্ববৎ। আবার ওই ছোট্ট কালো পর্দাটি বাক্স আড়াল করতেই মুক্ত অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে এলেন জাদুকর গনপতি।এখানেই শেষ নয়।গনপতির সামনে ওই ছোট্ট কালো পর্দা ঝোলাতেই মূহুর্তে উধাও তিনি।শেষে বাক্সের দড়ি খুলে,তালা খুলে,ভেতরের থলি খুলে হাত পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হল জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীকে। শান্তিনিকেতনে এই জাদুর আসরটির বর্ণনাটি পাওয়া যায় পরিমল গোস্বামীর ‘স্মৃতি চিত্রণে’।
ভারতীয় জাদুর খেলায় অজস্র উদাহরণ রয়েছে এমন। জাদুকর হ্যারি হুডনি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর বিপ্পদজনক ‘ইলিউশন বক্সের’ খেলায়।কখনও গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে বাক্সবন্দি হ্যারিকে আবার কখনও রেললাইনের ট্র্যাকে। ট্রেন আসার আগে হ্যারি বাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছেন দু সেকেন্ডের মধ্যে। সেহি সালামত। প্রতিবেদনের শুরুতেই এই গল্পগুলি টেনে আনার বিশেষ কারন একটাই তা হল ‘ইলিউশন বক্স’। কেন্দ্রবিন্দুতে বাক্স রহস্য।তৎকালীন শান্তিনিকেতনের দর্শক থেকে আজকের পাঠককূলের মনে কিন্তু প্রশ্ন একটাই। বাক্সের কারসাজি জানতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। ভোজবাজি থেকে ভানুমতি কা খেল। ম্যাজিক থেকে ইন্দ্রজাল। আর এখন ইলিউসেনিষ্ট। ভানুমতির বাক্স ছাড়া সব খেল খতম।
ভারতীয় ম্যাজিক আর তার কারসাজি কিন্তু ভানুমতির বাক্সেই বন্দি হয়ে থাকেনি বরং সেখানে এসেছে পেশাদারিত্বের ছোঁওয়া। সেই ভানুমতির বাক্সকে ব্র্যান্ডিং করেই শুরুয়াতি ব্যবসায় নেমেছেন শিল্পশহর আসানসোলের সৌম দেব। সৌম নিজে একজন স্বনামধন্য জাদুকর।এই প্রজন্মের ভারতীয় জাদুশিল্পীদের মধ্যে সৌম দেব বহু চর্চিত নাম।ছোট থেকেই ম্যাজিকের প্রতি আসক্তি। অল্প বয়সে বাবা মা কে হারিয়ে অভাবের পড়লেও নিজের পড়াশুনা এবং ভালোবাসার ম্যাজিককে ছাড়েননি।ম্যাজিক শিল্পকেই পেশা করে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন তিনি। একক শো করেছেন এশিয়া মহাদেশ জুড়ে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সেই দেশ বিদেশের প্রচুর পুরস্কার আজ সৌমর ঝুলিতে। বর্তমানে আসানসোলের কল্যানপুরে নিজের বাড়িতে সদা ব্যস্ত তার ম্যাজিকের কারখানা নিয়ে। নিজে জাদুকর তাই জাদুবিদ্যার কারিগরি দক্ষতা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন এই শিল্প কারখানা গড়তে পেরেছেন তিনি। এ এক নতুন চ্যালেঞ্জ।কলা বিভাগে স্নাতক হলেও পড়াশুনা করেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে।আবার শান্তিনিকেতন থেকে ডিপ্লোমা করেছেন গ্রাফিক আর্ট নিয়ে।প্যানিস গিটারেও ওস্তাদ। সমস্ত কারিগরি বিদ্যা আর নিজের অধ্যাবসায়ের চেষ্টায় তৈরি করেছেন নিজস্ব কোম্পানি ।সরেয়ার ম্যাজিক এন্ড ইলিউশনস কোং।অর্থ্যাৎ ভোজবাজির কারখানা।যার ট্যাগ লাইন ‘A Leading Illusion Maker of India’…।
সৌম জানাচ্ছেন সারা দেশের দশ হাজার রেজিষ্টার্ড ম্যাজিশিয়ান এখন তার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ভারতবর্ষের মোট চারজন এই রকম শিল্পকারখানা নিয়ে পেশাদারি কাজ করেন। তার মধ্যে তিনি একজন। কাজটা কিন্তু খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ এক এমন কারখানা যেখানে অস্থায়ী ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক নিয়ে দৈনিক কাজ করতে হয়। আবার গোটা ব্যাপারটাই করতে হয় খুব গোপনীয়তার সঙ্গে। যেন ম্যাজিক সিক্রেট কোড ব্রেক না হয়ে যায়। এক একটা ম্যাজিক বক্সে বা ইলিউশন বক্সে মজুত থাকে সব রকম সরঞ্জাম। কাঠ লোহা মেটাল অ্যালুমুনিয়াম কাপড় রং ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি। সবটা নিয়ে একটা পূর্ন ম্যাজিক বক্স।কাজের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে কাঠ মিস্ত্রী, ওয়েলডিং মিস্ত্রী, টেলর মাস্টার, রং মিস্ত্রী আবার ইলেকট্রিক মিস্তিরিদেরও। তাও আবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। সবটা নিয়ে সৌম আসানসোলে তার কারখানায় বিজ্ঞান আর কারিগরি প্রযুক্তির সাহায্যে গড়ে ফেলছেন অত্যাধুনিক ভানুমতি কা পিটারা।পুরাতন ম্যাজিক ইনস্টুমেন্ট যেমন টেবিল অফ দ্য ডেথ, জিগ জ্যাগ গার্ল, ডেগার হেড বক্স, ইল্যাসটিক লেডি, ডোলি ইলিউশন, টেম্পল অব ইন্ডিয়া তৈরি হয়ে যাচ্ছে নানা আঙ্গিকে।সৌম জানাচ্ছেন পুরাতন সেইসব ম্যাজিকে আনা হচ্ছে নতুনত্বের ছোঁওয়া।কারন আজকের সোশ্যাল মিডিয়া আর ইউটিউবের জামানার দর্শকদের বিশ্বাস যোগ্যতা আনতে ম্যাজিকগুলোতে আনতে হচ্ছে নানা টুই্যস্ট। বিশেষ করে এক্সএন চ্যানেলে ব্রেকিং দ্য ম্যাজিশিয়ান’স কোড অনুষ্ঠানের পর ম্যাজিকের অনেক কৌশলই ফাঁস হয়ে গেছে জনসমক্ষে। ফলে সেই আকর্ষণ ফেরাতে নয়া কৌশল আয়ত্ব করতে হচ্ছে সৌমকে। ওই অনুষ্ঠানের মাস্ক ম্যাজিশিয়ান ভ্যালেন্টিনো যে ম্যাজিক গুলির গোপনীয়তার কৌশল ফাঁস করেছেন তার বেশীর ভাগ ম্যাজিকগুলি এখনও একই কায়দায় ভারতীয় ম্যাজিশিয়ানরা স্টেজে শো করেন। আর সেখানেই চ্যালেঞ্জ সৌম আর তার রেয়ার ম্যাজিক এন্ড ইলিউশন’স কোম্পানীর।
জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে সৌমকে। স্কুলে পড়াশুনা চলাকালীন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবা।কিছুদিন পরেই কিডনি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মা। পিতৃ মাতৃহীন একা নিঃসঙ্গ কেটেছে তার একটা বড় সময়। নিকট আত্মীয় কেউ ছিলেন না পাশে দাঁড়াবার মতো।স্কুলে পড়াকালীন ম্যাজিক দেখেছিলেন হাওয়া থেকে টাকা পয়সা আনছেন ম্যাজিশিয়ান। শিশু মনের গেঁথে গেল ভাবনা। টাকা কামাতে হলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র নয় ম্যাজিশিয়ান হতে হবে।জীবনের অ্যাম্বিশন ম্যাজিশিয়ান হওয়া। বড় হয়ে সেই ভাবনার ভ্রান্তি দূর হলেও আসক্তি কাটেনি ম্যাজিকের থেকে। ম্যাজিকের মতো গুরুবিদ্যা অর্জন করতে নানা ম্যাজিশিয়ানের খোঁজে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পথেঘাট, মেলা বা শহরের মঞ্চ যেখানেই ম্যাজিক সেখানেই সৌম। পরে ম্যাজিক শিখে ছোটখাটো কল শো পাওয়া। গিটার বাজাতে জানতেন। শুধু ম্যাজিক শেখার জন্য অলিম্পিক সার্কাসে সৌম ঢুকেছিল মিউজিশিয়ান হিসাবে। একদিকে মিউজিশিয়ান অন্যদিকে সার্কাসের ম্যাজিশিয়ান। সার্কাসের সূত্র ধরেই বিশ্ব বিখ্যাত জাদুকর ‘কে লালের’ সন্ধান পান। যুক্ত হয়ে পড়েন 'কে লালের' সঙ্গে। দীর্ঘদিন ধরে 'কে লালের' সহায়তাকারী হিসাবে কাজ করে ম্যাজিক বিদ্যা শেখেন তিনি। পরে একক শো শুরু করেন ‘সৌম্যাজিক ও তার ইন্দ্রজাল’ নাম নিয়ে।এখন তাঁর যোগ্য সহযোগী স্ত্রী তাপসী আর মেয়ে একাদশ শ্রেনীর ছাত্রী পিয়ালি। ছোট থেকেই বাবার সাথে মঞ্চে সাবলীল। মঞ্চে তিনজনেই সমান দক্ষ। রোমাঞ্চ আর বিস্মিত করে দর্শকদের বসিয়ে রাখতে পারেন ঘন্টার পর ঘন্টা। এখন এদেশে পিসি সরকার জুনিয়র শুধু নয় গোটা পরিবার একসাথে ম্যাজিক শো করেন সৌমদেবের পরিবারও। সৌমর পুরস্কারের তালিকা দীর্ঘ। ম্যাজিক ক্রিয়েটর সম্মান পেয়েছেন লন্ডনের রিপ্রো ম্যাজিক থেকে। দিল্লীর মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন শীলা দিক্ষিত দিয়েছিলেন এক্সিলেন্স ইন ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড পুরস্কার। রাজস্থানের মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন অশোক সিং গেহলট দিয়েছিলেন ম্যাজিকের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। তার আগে রাজস্থান সরকারের পক্ষে তিনি পেয়েছেন জাদুসূর্য পুরস্কার। লখ্ণৌ রোটারি ক্লাব কতৃক ম্যাজিশিয়ান অব দ্য ম্যাজিশিয়ান’স। চেন্নাই লায়ন্স ক্লাব দিয়েছে ম্যাজিক এক্সিলেন্স পুরস্কার। এছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ, গোয়া, পাঞ্জাব সরকার কতৃক নানা সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ মালেয়শিয়া ও নেপালে সার্ক ফেস্টিভেলও তিনি নানা অনুষ্ঠান করেছেন।
সৌমদেব পূর্ণ যুক্তিবাদী মানুষ।কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাঁর মতে ম্যাজিক মানেই আগে ছিল বোকা বানানোর গল্প। অতীতে মানুষের সমাজে প্রথম জাদুকরেরা ছিলেন পুরোহিত বা গুরুজাতীয় অসাধারণ ব্যক্তি। সম্পূর্ণ লৌকিক উপায়ে রহস্যময় ক্রীয়া কলাপের অনুষ্ঠান করতো এরা। সেইসব কিছু সাধারণ মানুষ ভীতি এবং শ্রদ্ধা মেশানো বিস্ময়ের চোখে দেখতেন আর ভেবে নিতেন অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন ঐশ্বরিক জাদুক্ষমতার অংশীদার।অনেক পরে জাদুবিদ্যা অলৌকিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে এসেছে লৌকিক মনরঞ্জনের এলাকায়।এখন জাদুকরদের আশ্চর্য কান্ডকারখানা দেখে আমরা বিস্মিত হলেও তাকে আলৌকিক ক্ষমতার অধিকারি বলে ভাবি না।এটা আমরা জানি তিনি কৌশলে আমাদের চোখ আর মনকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়েছেন মাত্র। তাই সিনেমার ডায়লগের মতো সৌম হাসতে হাসতে জানান দর্শকদের খেলা দেখানোর সময় তিনটে বিষয় মাথায় রাখতে হয়-entertainment entertainment & entertainment।