পার্পল সোয়াম্পহেন বা ব্ল্যাকহেডেড আইবিশের মতো অনেক পাখিকেই আমরা ডিসকভারি চ্যানেল দেখে শিখেছি। টিভির পর্দা বা গুগল আঙ্কেল ছাড়া খালি চোখে এসব পাখি দেখেছেন কখনও! যাঁরা পাখি প্রেমী। ওতপেতে বসে থাকেন জলে জঙ্গলে তাদেরও চোখ পড়েনি হয়তো এরকম সব নাম জানা না জানা পাখির হদিস পেলাম মংলাজোড়িতে গিয়ে। গত মার্চে গেছিলাম। ওড়িশার গঞ্জাম জেলায় চিল্কার উত্তর প্রান্তের একটা ছোট্ট গ্রাম এই মংলাজোড়ি। পাশেই চিল্কা তাই ছোট ছোট খাল বা খাঁড়ি দিয়েই ঘেরা গ্রামটা। আর এই পরিবেশটাই এইসব পরিযায়ী পাখিদের বিচরণের জন্য আদর্শ জায়গা। জলা জায়গার সাথে হালকা ঝোপ ঝাড়ে ঘেরা এই গ্রামেই শীতকালেই আসেন এই সব পাখিরা। কোনওটা আসে রাশিয়া থেকে। সাইবেরিয়ার বরফ ঢাকা মরুভূমি উতরে কোনওটা আসে জাপান উত্তর কোরিয়া চীন কিংবা ইরান থেকে। মংলাজোড়িতে তখন গোটা বিশ্বের পাখিদের সম্মেলন চলে। শুধু খাবারের সন্ধানেই নয় ওরা আসে একসাথে থাকে ওড়িশার হাড়হাভাতে মানুষগুলোর সঙ্গে। কয়েকটা দিন কাটিয়ে যায় হয়ত বলে দুঃখ কোরো না ভাই আমরা আছি তোমাদের পাশে।
মংলাজোড়ি। এই গ্রামের গল্পটাও বেশ মজার। এলাকার মানুষের মুখে মুখেই ফেরে গল্পটা। বলা হয় এখন যেমন পাখি মানুষে দোস্তি সেদিন সেরকম ছিল না। গরিব গ্রামের গরিব মানুষ এইসব বিদেশী পাখিদের দেখলেই ধরে ফেলত। স্থানীয় বাজারে চড়া দামে বেঁচে দিত। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল পাখি নির্যাতন। এতে কারও কারও লাভ হত ঠিকই কিন্তু আদতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল পাখিদের আনাগোনার আর পাখি শিকারের রমরমাও কমছিল। কারণ বাজার ছিল ঠিকই কিন্তু ক্রেতারা আর চড়া দাম দিতে রাজি হচ্ছিল না। ফলে গ্রামের মানুষের পাখির শিকারের ওপর ভরসা করে যে রুটি রুজি চলত তাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এরকম সময়ে পাখিদের সাথে দোস্তির প্রস্তাব নিয়ে আসেন স্থানীয় কিছু শিক্ষিত যুবক। নন্দ কিশোর ভুজবল আর পূর্ণ বেহেরার নেতৃত্বে গ্রামের মানুষ খুঁজে পায় অন্য একটা সুরাহা। প্রেমের সেই পথ ভালো লেগে যায় মংলাজোড়ির। তাঁরা ঠিক করে যে সরকারের সাথে কথা বলে তাঁদের সাহায্য নিয়ে এইসব পাখিদের সংরক্ষণ করা হবে। এখানেই একটা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। যেখানে পাখিরা আসবে আদিগন্ত পেরিয়ে। পাখি প্রেমী মানুষও আসবে চারদিক থেকে। এভাবেই মংলাজোড়িতে গড়ে উঠবে পর্যটন। খালবিল ঘেরা এই ছোট্টগ্রামে গোটা দুনিয়ার পাখি আসে আজ। আর আসে গোটা দেশের মানুষ। আর তাদের আপ্যায়ন করেই দিব্যি চলে যাচ্ছে মংলাজোড়ির।
পাখি শিকার বন্ধ হওয়ায় পাখিদের আস্থাও ফিরে পেয়েছে এই গ্রাম। আর এভাবেই গড়ে উঠেছে মংলাজোড়ি ইকো ট্যুরিজম পার্ক। আর.বি.এস ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান গ্রামীণ সার্ভিস, চিল্কা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এবং ডিপার্টমেন্ট অফ ফরেস্ট এর তত্ত্বাবধানে এই ইকো ট্যুরিজম পার্কটি দারুণ চলছে। পার্ক কর্তৃপক্ষের দাবি ফি বছর লাখ তিনেক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায় এখানে। বছরের অক্টোবর থেকে মার্চ মাস অবধি হল সবথেকে ভালো সময় এখানে আসার।
যারা আগে পাখি শিকার করত তাঁরাই এখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে। পর্যটকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাখি দেখায়, পাখিদের বংশ বিস্তারের জন্যে নিরিবিলি তৈরি করে। ছাউনি দেওয়া নৌক করে জলে জঙ্গলে ঘোরায় ওরাই। চিল্কা হ্রদের থেকে বেরিয়ে আসা জলাশয়ের মধ্যে দিয়ে দারুণ সব পাখি সাফারির ব্যবস্থা করেন এই মানুষগুলোই। কাঠ আর বাঁশ দিয়ে এরা তৈরি করেছেন পর্যটকদের থাকার জন্য কটেজ। ইকোট্যুরিজমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। পর্যটকদের সেবায় ওঁরাই দিনরাত লেগে আছে। পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিভাবে একটা পর্যটন কেন্দ্রকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় সেদিকেই মূলত কাজ করে চলেছে এখানকার মানুষ। দূষণ-মুক্ত পরিবেশ-বান্ধব একটা পার্ক তৈরি করে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানোই আসলে এদের প্রধান উদ্দেশ্য। আর এই কারণেই ২০১২ সালে আর বি এস আর্থ হিরো অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৪ সালে ইন্ডিয়া বায়ডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড রানার আপ পুরষ্কার পেয়েছেন এঁরা।
গরিব মানুষগুলোই দেখিয়ে দিতে পেরেছেন যে স্বদিচ্ছা থাকলে ভারতের আরও বিভিন্ন জায়গায় এরকম ইকোট্যুরিজ্ম পার্ক তৈরি করা সম্ভব। শুধু মা নিষাদের মন্ত্রটা মাথায় রাখলেই একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব অন্যদিকে পর্যটন শিল্পকেও একটা নতুন দিক দেখানো সম্ভব। মংলাজোড়ির এই মডেলে শুধু পাখিরাই উপকৃত হয়েছে তা নয়, এখানকার অনেক লুপ্তপ্রায় প্রাণীরাও ফিরে পেয়েছে নিজেদের জীবন।