বাংলার নিজস্ব মাদামতুসোর কারিগর সুশান্ত
কলেজ শেষ না করেই একদল বন্ধু বান্ধবী হঠাৎ উধাও।কয়েক ঘন্টা পর ছাত্রীর ফেসবুকে হঠাৎ আপলোড শাহরুখের সাথে খুনসুটির মূহুর্ত।আরেক ছাত্রের এফবি টাইম লাইনে ততক্ষনে মারাদোনার সঙ্গে বল কেড়ে নেওয়ার দৃশ্য।মূহুর্তের মধ্যে লাইকের বন্যা।সবার মনে প্রশ্ন কোথায়?কখন? ভাবছেন লন্ডন কিংবা বার্লিন ? মাদাম তুসোর মিউজিয়াম?উঁহু! এক্কেবারে খাস কলকাতা।মহানগরীর নিজস্ব মাদামতুসো।ভিক্টোরিয়া ,সায়েন্স সিটি ,নিক্কো পার্ক ঘুরতে যাওয়া বাঙালিদের এখন নিউ ডেস্টিনেশন।নিউটাউনের মাদার্স ওয়াক্স মিউজিয়াম।যেখানে থিমেটিক আবহে আপনার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন নেতাজী থেকে নজরুল।
মারাদোনা থেকে কপিল দেব।অমিতাভ থেকে মিঠুন।প্রবেশ মূল্য ১৫০ টাকা।তাতে কি?হিট শো।শুধু টিকিট বিক্রি করেই এক বছরের ভেতরেই মোম মিউজিয়াম থেকে রাজ্যের আয় ৩ কোটি টাকা।কিন্তু এতবড় কর্মকান্ড যার জন্য সেই মোমের দেশের কারিগর তিনি বঙ্গসন্তান।শিল্পশহর আসানসোলের ভাস্কর শিল্পী সুশান্ত রায়।এ দেশের মধ্যে মাত্র দুজন রয়েছেন মোম ভাস্কর শিল্পী।সুশান্ত রায় তার একজন।বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। একমাত্র তার উপর ভরসা করেই এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে হিড়িক পড়েছে ওয়াক্স মিউজিয়াম তৈরির।বাংলা ছাড়াও রাজস্থানের ওয়াক্স মিউজিয়ামের কাজের বরাত নিয়ে এখন ব্যাস্ত আসানসোলের সুশান্ত।
অথচ আশির দশকে যখন ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে মডেলিং এণ্ড স্কাল্পচারে ডিগ্রী নিয়েছিলেন তখন মোমের মূর্তি গড়বেন তা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেন নি এই ভাস্কর শিল্পি ।২০০১ সালে প্রথম মোমের কাজ করার কথা ভাবেন- সৌজন্যে বিগ বি।মাদাম তুসোয় তখন সুশান্তকে ডাকা হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনের শরীরে মাপ নেওয়ার জন্য।আর তখনই মাথায় আসে আইডিয়াটা।তিনিও বানাবেন মোমের মূর্তি যেমন ভাবা তেমন কাজ।২০০২ এ প্রথম অমিতাভ বচ্চনের মূর্তি। ২০০৩ এ পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী জ্যেতি বসু।তারপর শচীন তেন্ডুলকার।কপিল দেব।রোনাল্ডো।মারাদোনা।করুনানিধি।বিভিন্ন ফ্যান ক্লাবের দৌলতে জুটতে থাকে একটার পর একটা বরাত।শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় বরাত আসতে থাকে রাজ্যের বাইরের থেকেও।বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে মাদাম তুসোর ওয়াক্স মিউজিয়ামের ।এ দেশের অনেকেরই সেই মিউজিয়াম সরেজমিনে না দেখলেও টিভিতে কাগজে দেখেছেন।বিদেশের সেই মিউজিয়ামের মূর্তির মতো পাল্লা দিয়ে এদেশীয় সুশান্ত রায়ের কাজ দেখে অভিভূত হয়ে যান সকলেই।
এরকম গুনী শিল্পীকে হাতের কাছে পেয়ে প্রয়াত রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ প্রথম চক্রবর্তী ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যুব ভারতীতে মোমের মিউজিয়াম তৈরি করার।বেসরকারি সংস্থা পথের পাঁচালির থেকে বরাত দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব থেকে নাট্যকার অভিনেতা অভিনেত্রী মনিষীদের মোমমূর্তি গড়ার।সেই থেকে উত্তম কুমার, কিশোরকুমার, মান্না দে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মিঠুন চক্রবর্তী লতা মঙ্গেশকর, এক এক করে নিখুতভাবে তৈরি করেছেন তিনি।এমনকি ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে প্রনব মূখোপাধ্যায়কে মোমের মূর্তি দিয়ে এসেছেন শিল্পী।
২০১৪ সালে রাজারহাট ফিন্যানসিয়ালি হাবে তৈরি হয়েছে মাদার্স ওয়াক্স মিউজিয়াম।জাতীয় টেন্ডারে মিউজিয়ামে প্রথমধাপে ১৯ টি মোম মূর্তির বরাত পেয়েছিলেন শিল্পী সুশান্ত রায়।বঙ্গবন্ধু মাদার টেরিজা রামকৃষ্ণ সহ পরে আরও বেশ কিছু ওর্ডার পান তিনি।আসানসোলের মহিশীলা কলোনীতে জন্ম।দশম শ্রেনীতে পড়ার সময় বাঁশ দিয়ে গড়েছিলেন সরস্বতীর মূর্তি।সেই শুরু।কখনও পুঁতি আবার কখনও মোম দিয়ে ঠাকুর মূর্তিও গড়েছেন একসময়।কলেজে অবশ্য ভর্তী হয়েছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে।পরে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট কলেজে।
আজকের এই সাফল্য দেখে ঈর্শা করতেই পারেন অনেকে।কিন্তু পথটা কি মসৃণ ছিল?কি বলছেন সুশান্ত রায়?মনে মনে ঠিক করেছিলেন মাদাম তুসোর মিউজিয়ামের মতো মোমের মূর্তি বানাবেন কিন্তু প্রথমেই ধাক্কা।মাদাম তুসোয় সেলিব্রিটিদের নানা অ্যাঙ্গেল থেকে শরীরী মাপ নেওয়া হয়।কিন্তু তিনি তো শুধু শ্রেফ ছবি দেখে হুবহু আমিতাভ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।কিন্তু হাল ছাড়েননি।পঞ্চমবারের চেষ্টায় আসে সাফল্য।সেটা ২০০২।বচ্চন ফ্যান ক্লাবের সৌজন্যে চেয়ারে বসা মূর্তি দিয়ে আসেন বিগবির বাংলো প্রতীক্ষায়। পরে শুনেছিলেন তিনি খুব প্রশংসা করেছিলেন।সেই শুরু।২০০৩ এ তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়া মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী যোগাযোগ করেছিলেন প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী জ্যেতি বসুর মোমের মূর্তি গড়ার জন্য।টানা দু মাস খেটে মূর্তিটা বানানো হয়েছিল জ্যেতি বসুর জন্মদিনে উপহার দেওয়ার জন্য।ভরা ব্রিগেডে দুই জ্যেতি বসুকে সেদিন একসাথে প্রথম দেখেছিলেন রাজ্যবাসী।নিজের মূর্তি দেখে খূশি হয়েছিলেন প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী।উচ্ছসিত সুশান্ত জানাচ্ছেন মোমের মূর্তির পকেটে একটি কলম গুঁজে দিয়ে জ্যেতি বাবু বলেছিলেন এবার পারফেক্ট।শুধু এটুকুই পূর্ণতার অভাব ছিল।সেখানে হাজির ছিল মিডিয়া।ব্যপক প্রচার।আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেকে মোমের মিউজিয়াম বানানোর পরিকল্পনা করে হিডকো।নানা প্রশাসনিক ধাপ পেরিয়ে বরাতটা তিনিই পান।সুশান্ত জানাচ্ছেন একটা মূর্তি গড়তে গড়ে যেখানে এক মাস দশ দিন সময় লাগে,সেখানে এক বছরও সময় পাওয়া যায়নি ১৯ টা মূল মূর্তির সঙ্গে কয়েকটি জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের মূর্তি বানাতে।এক একটি মূর্তিতে কুড়ি থেকে বাইশ কেজি মোম লাগে।সুশান্ত রায়ের দাবী তিনি পৃথিবীর যেকোন মোম শিল্পীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। শুধু ছবি দেখে হুবহু মোম মূর্তি বানিয়ে তিনি দেখাতে পারেন।তিনি বলেন মাদাম তুসোয় কাজের মান নিয়ে কথা বলার স্পর্ধা তার নেই ।ওরা যত খরচ করে মূর্তি গড়তে সে অঙ্কের ধারে কাছেও তিনি পৌঁছাতে পারবেন না।এক একটা মূর্তি গড়তে ভারতীয় মুদ্রায় গড়ে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়।সেখানে জামা কাপড় গয়নাগাটি আর অ্যাক্সেসারিজ বাদে এখানে গড় পড়তা খরচ পড়ে লাখ দেড়েকের মতো।এই প্রতিকূলতা নিয়েও তিনি কাজ করে চলেছেন একাই।
বাংলার পর এবার রাজস্থান সরকারের উদ্যোগে জয়পুরে হচ্ছে একটি মোম মিউজিয়াম।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মায়ের মূর্তিও থাকবে সেখানে।সেই কাজের বরাত তিনি পেয়েছেন।বাংলার মিউজিয়ামের জন্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের মূর্তি সুশান্ত গড়েছিলেন এবার জয়পুরের জন্য পাঠাবেন।এছাড়াও আরও পনেরোজন বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের মূর্তির বরাত তাকে দেওয়া হয়েছে।সার্ভিস ট্যাক্স পরিবহন সহ মূর্তি পিছু খরচ চার লাখ টাকা করে।মূর্তিগুলি ছয় টুকরো করে পাঠানো হবে।জয়পুরে গিয়ে তিনি আবার জোড়া লাগাবেন।সুশান্তর ইচ্ছা পরের প্রজন্ম এই কাজ শিখুক।কিন্তু এতটাই কঠিন কেউই রপ্ত করতে পারছেন না।তাই চাপ বাড়ছে তার একার উপর।সুশান্তর স্বপ্ন ভবিষ্যতে একটা ওয়াক্স মিউজিয়াম ও আর্ট একাডেমি গড়ার।