রুকবান চিত্রকর, তবে পরিচিত স্বর্ণ বলেই। বয়স ৪০ ছুঁয়েছে। বসবাস পশ্চিম মেদিনীপুরের পিঙলা ব্লকের নয়া গ্রামে। বছরে ২-৩ বার পাড়ি দেন বিদেশ, নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে। এ ছাড়াও সারাবছরই ব্যস্ততা লেগেই থাকে। স্বর্ণ চিত্রকর আজ এরাজ্যের পটচিত্র শিল্পীদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য নামগুলির একটা। তবে এই জায়গায় পৌঁছনোটা সহজ ছিল না। একজন মহিলা হিসেবে লড়াইটা ছিল আরও কঠিন।
ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার কালিঘাট এলাকায়। পট আঁকার প্রচলন ছিল পরিবারেই, তবে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল নিষিদ্ধ। বাবা পট আঁকতেন, আর বাবার দেখাদেখি গুড়াকু দিয়ে রাস্তাতেই ছবি আঁকত মেয়ে। প্রথমে বকাবকি করলেও মেয়ের আঁকার হাত দেখে মুগ্ধ হন বাবাও, এরপর থেকে বাবার পটের শেষটুকু রঙ করা, রঙ বানান ইত্যাদির দায়িত্ব পায় স্বর্ণ। ভাইদের সঙ্গে সেও হাত মেলায় পট আঁকায়। এরই মধ্যে পরিবার ফিরে যায় নয়া গ্রামে, সামাজিক নিয়ম মেনেই বিয়ে হয়ে যায় নাবালিকা স্বর্ণর। ছবি আঁকা তো বন্ধ হয়ই, শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয় অত্যাচার। ততদিনে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে স্বর্ণ। মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসে বাবার কাছে। পট আঁকাকেই সম্বল করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হয়। কিছুদিন পর স্বামীর সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেলেও আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যায়নি স্বর্ণ। স্বামীর সঙ্গে ঘর বাঁধেন নয়াতেই, আর চালিয়ে যান আঁকা।
ক্রমশই জনপ্রিয়তা বাড়ে পটশিল্পের, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই শিল্প। তখন স্বর্ণ ছাড়াও আরও কিছু মেয়েরাও আঁকতে শুরু করেছে। স্বর্ণ বললেন, তাঁদের গুরু গৌরি চিত্রকর ও দুখুশ্যাম চিত্রকরই মূলত প্রথা ভেঙে মেয়েদের আঁকার প্রচলন শুরু করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই এক সুযোগ আসে, অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয় পটচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে একটি প্রজেক্ট করার জন্য গ্রামে আসে। মাস খানেক পটচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার শিল্পী-অধ্যাপকরা। স্বর্ণর অসাধারণ আঁকার দক্ষতায় মুগ্ধ হন তাঁরা। প্রজেক্টের শেষ অংশে তিনজন শিল্পীর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ছবি আঁকার কথা জানান হয়, স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে স্বর্ণর নাম। গ্রামের প্রধান শিল্পী ও গুরু দুখুশ্যাম চিত্রকরের সঙ্গে স্বর্ণ ও গ্রামের আরেক মহিলা শিল্পী ময়না চিত্রকরের নাম বেছে নেওয়া হয়। স্বর্ণ তখন সন্তানসম্ভবা। স্বামী সাফ জানিয়ে দেন বিদেশ যাওয়া হবে না। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা শিল্পীরা হতাশ হন, শুরু হয় এক নতুন লড়াই। “আমি যাবই এটা ঠিক করে নিয়েছিলাম, টাকাটা ব্যাপার নয় কিন্তু এই সম্মান আর সুযোগ হারানোর প্রশ্নই ওঠে না। গ্রামে তেমন ডাক্তার ছিল না, অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা বন্ধুদের বলি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে, ডাক্তার অনুমতি দেন। এরপর আর না যাওয়ার কোনও কারণই ছিল না। মেয়েকে বাড়িতে রেখে, পরিবারের অমতেই দুখুশ্যাম ও ময়নার সঙ্গে পাড়ি দেন অস্ট্রেলিয়া। “দুখু মামা খুব সাহায্য করেছিল, সাহস জুগিয়েছিল। সেই প্রথম বিদেশ, ভাষা জানিনা, এই গ্রাম থেকে গিয়ে পড়েছি অতবড় একটা শহরে। মেলবোর্নে ছিলাম আমরা। হইহই করে কেটেছিল কটা দিন, আর শিখেছিলাম অনেক, সবথেকে বড় যেটা হয়েছিল, নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল অনেকটা”, বললেন স্বর্ণ।
এরপর গ্রামে ফিরে আর খুব বেশি ভাবতে হয়নি স্বর্ণকে, পটশিল্পী হিসেবে ক্রমেই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে স্বর্ণ। ডাক পড়েছে দেশের নানা প্রান্তে, বাড়ি এসে আঁকা নিয়ে গেছে নামী দামি গ্যালারি, প্রদর্শনী। “অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরিবারের আপত্তি, স্বামীর নিষেধ ইত্যাদির বাধা আর ছিল না ঠিকই, কিন্তু সে তুমি যতই শিল্পী হও, নাম কর, সংসার তোমায় ছাড়বে না। এরই মধ্যে আরও তিন মেয়ে হয়েছে আমার, সংসারের যাবতীয় কাজ সব সামলেই আঁকা চালিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। একজন পুরুষ শিল্পী তো শুধু তাঁর আঁকা নিয়েই থাকতে পারে, মেয়ে বলে আমার খাটুনিটা দ্বিগুণ ছিল, খুব কষ্ট করেছি”, বলছিলেন স্বর্ণ। এরই মধ্যে সহ-লেখক হিসেবে বইও প্রকাশিত হয়েছে।
পটশিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই ছবি আঁকার বিষয়ে এসেছে বিভিন্নতা। নিজেদের সাবেকী পটের পাশাপাশি নতুন নতুন সামাজিক বিষয় নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেছেন পটশিল্পীরা। স্বর্ণর আঁকায় বারবারই ঘুরে ফিরে এসেছে নারী নির্যাতনের কথা, নারীমুক্তির কথা। নির্ভয়া ঘটনার পর এক দীর্ঘ ও মর্মস্পর্শী পট এঁকেছিলেন স্বর্ণ। “মেয়েদের কথা তো মেয়েদেরই বলতে হবে, আমি তো আমার জীবন দিয়ে জানি একজন মেয়েকে কত কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয় শুধুমাত্র নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, নিজের সম্মান আদায়ের জন্য। পরিবারের সমস্যা তো ছিলই, এই যে এত বাইরে যাই সমস্যা কী সেখানেও কম! গ্রাম-শহর, গরীব-বড়লোক এগুলো কোনও ব্যাপারই না, সব মেয়েদেরই একইরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এগুলোর বিরুদ্ধে বলতে হবে, আমার তো এই ছবি আঁকা আর গান গাওয়াই আছে, এটা দিয়েই আমি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারি। এবিষয় সচেতনতা বাড়ানো খুবই দরকার, বললেন স্বর্ণ।
সারাবিশ্বের লিঙ্গ-রাজনীতি,নারীমুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে জানেন? “আমাদের প্রত্যেকটি মেয়ের জীবনই তো একেকটা আন্দোলন, লড়াই। আমরা যারা সমাজের এত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছি। কখনও সফল হচ্ছি কখন চাপের মুখে ভেঙে যাচ্ছি, কিন্তু লড়াইটা তো চলছে। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় যখন গেছি শুনেছি এসব আন্দোলনের কথা, লড়ে তো যেতেই হবে”, হাসি মুখে বললেন স্বর্ণ।
নিজের মেয়েদেরও ছবি আঁকা শিখিয়েছেন স্বর্ণ। বড় মেয়ে মামণি চিত্রকর ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। মা-মেয়ে মিলে ২০০৮ সালে ঘুরে এসেছেন ইতালি, একটি প্রদর্শনীতে। এরপর বাহারিন গেছে মামণি। এছাড়া দেশের নানা শহরে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে।
নিজের মেয়ে ছাড়াও গ্রামের অন্যান্য মেয়েদেরও একইভাবে সাহায্য করেন স্বর্ণ। গ্রামের রিসোর্স সেন্টারে নিয়মিত বাচ্চাদের আঁকা শেখান। “আমাদের এই প্রাচীন শিল্পকে বাঁচাতে হবে, আর বাঁচাতে হবে মেয়েদের। সংসারের পাঁচটা আসবাবের মত বাঁচা নয়, সকাল থেকে রাত খেটে কোন স্বীকৃতি না পাওয়ার বাঁচা নয়, সত্যিকারের মানুষের মতো বাঁচা, নিজের পরিচয় বাঁচা। শিল্পী হিসেবে যা পাওয়ার আমি পেয়েছি, এখন আমার লক্ষ্য এটাই। যতটুকু পারি করে যাব”,বললেন স্বর্ণ চিত্রকর।