একতার আঁকা দেখে মুগ্ধ মহেশ, কুর্নিশ শাহরুখেরও
ডিজিটালের চোখ রাঙানিতে প্রায় লুপ্ত প্রজাতির খাতায় নাম তুলে ফেলেছে হাতে আঁকা পোস্টার। সিনেমা হল তো বটেই নাটকপাড়াতেও ওই পোস্টার দূরবীন দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। তবে মুছে ফেলা যায়নি একেবারে। সেই ঘরানার পোস্টার এখনও যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের মধ্যে একতার নাম প্রথম দিকেই আসবে। একতা ভট্টাচার্য। এখনও পর্যন্ত নাটক, সিনেমা মিলিয়ে একশো চল্লিশটির ওপর পোস্টার প্রাণ পেয়েছে তাঁর রং-তুলি-ভাবনাতে।
প্রথম পোস্টারের কাজ একটি শর্ট ফিল্মের জন্য৷ বন্ধু তথাগত ঘোষ সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত৷ একটা শর্ট ফিল্ম বানিয়েছিলেন৷ ‘তথাগতকে একদিন আমি হাতে আঁকা পোস্টার নিয়ে আমার ভাবনার কথা বলি। সব শুনে ওর ছবির জন্য একটা পোস্টার তৈরি করতে বলে। সুযোগ হাতছাড়া করিনি। ঝটপট একটা পোস্টার এঁকে দিই। সেটা দেখে ওর খুব পছন্দ হয়ে যায়। সেটাকেই ওই ছবির পোস্টার করে দেয়৷ সেই আমার প্রফেশনাল জগতে হাতেখড়ি বলা যায়৷ তারপর অন্যান্য ছবি আর নাটকে কাজের জন্য ডাক পাই’,শুরুর দিনগুলির কথা মনে করে বলেন একতা৷
আঁকিবুকিতে প্রথাগত কোনও শিক্ষা নেই। শুধু ভাবনা,আবেগ আর নিজের শিল্পসত্ত্বাকে কাজে লাগিয়ে পোস্টারে প্রাণ সঞ্চার করেন একতা। প্রেরণা বলতে বাবা আর ছোটবেলার স্কুল। ‘আমাদের স্কুলেও প্রচুর আঁকার কাজ থাকত৷ সেগুলো বেশিরভাগই ছিল কোনও না কোনও থিমের উপর৷ বাবা আমাকে খুব সাহায্য করতেন৷ যদিও বাবারও সেই অর্থে আঁকাআঁকি নিয়ে প্রথাগত কোনও শিক্ষা ছিল না। তবু বাবার ভাবনাতেই ছোটবেলা থেকেই বিষয়ভিত্তিক আঁকার উপর আমার ঝোঁক তৈরি হয়’,বলছিলেন একতা।
আরও একজনের কাজ দারুণ প্রেরণা দেয় একতাকে। তিনি সত্যজিৎ রায়। একতা বলেন, ‘আমি সত্যজিৎ রায়ের আঁকা পোস্টার গুলোর ভীষণ ফ্যান৷ এই পোস্টারগুলো দেখতে দেখতেই মনে হত, এখন আর কেন হাতে আঁকা হয় না’? যদিওএখন ডিজিটাল মাধ্যমেই বেশিরভাগ কাজ হয়, তবু আমার মাথায় ভাবনাটা কাজ করতে থাকে৷ সেই থেকেই একদিন পোস্টার তৈরির কাজ শুরু করি’৷
এতদিন বাংলা সিনেমা-নাটকে ছিল তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। বিশিষ্ট পরিচালক মহেশ ভাটের হাত ধরে হিন্দি নাটকের আঙিনাতেও পা রেখেছেন। ‘হামারি আধুরি কাহানি’র পোস্টার তৈরি হল একতার ভাবনায়। বইয়ের পাতা থেকে পর্দায় উঠে এসেছে ‘হামারি অধুরি কাহানি’৷ এবার তা নাটকের মঞ্চেও৷ মঞ্চের আলোছায়াতেই অরভ-বসুধা আর হরি প্রসাদের ভালোবাসার কাহিনি৷ মহেশ ভাটের কাহিনির এই নাট্যরূপায়ণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকল এই বাঙালি কন্যার নাম৷ বাংলার বহু নাটকেরই পোস্টার তৈরি করেছেন তিনি৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কালমৃগয়া’ কিংবা ‘আত্মীয়স্বজন’-এর মতো নাটকের পোস্টার করেছেন একতা৷ তবে এই প্রথম তাঁর হিন্দি নাটকের দুনিয়ায় পা রাখা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর থেকে একে একে হিন্দি নাটকের কাজ আসতে থাকে। মহেশ ভাটের সঙ্গে ‘দো দিওয়ানে শহর মে’ করলেন সম্প্রতি। কথা চলছে অনুপম খেরের সঙ্গেও।
মহেশ ভাটের ‘হামারি আধুরি কাহানি’র সঙ্গে একতার যোগাযোগ নাটকের মুখ্য চরিত্রাভিনেতা ইমরান জাহিদের সূত্রে৷ তথাগত ঘোষের ছবি ‘ফেলিসিটি’ তে একতার করা ছবির পোস্টার দেখে ভালো লাগে ইমরানের৷ তিনিই একতাকে বলেন নাটকটির পোস্টার করে দিতে৷ ‘পুরও কাজটায় মহেশজির অনেকখানি ইনভলভমেন্ট ছিল৷ প্রথম পোস্টার করে পাঠানোর পর, উনি নিজে সেগুলো দেখে মতামত জানিয়েছিলেন৷ কোথায় কী বদল করা দরকার তার টিপস দিয়েছিলেন’,বলে চলেন একতা। সিনেমার পোস্টারে ছিল বিদ্যা-ইমরানের মুখ৷ একতা পোস্টার সাজালেন নিজস্ব ঢঙে। তাঁর কথায়, ‘গতে বাঁধা পথে হাঁটিনি৷চরিত্রগুলোর বিচ্ছেদ বোঝাতে ঝরাপাতা ব্যবহার করেছি। ভালোবাসা-বিচ্ছেদের ইনটেনসিটি সবই উঠে এসেছে রঙের ঘনত্বের হেরফেরে’।
একতা যখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী, তখন থেকেই পোস্টার আঁকা শুরু৷ তারপর ক্রমাগত এঁকে চলেছেন বিভিন্ন প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে৷ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রোজেক্টেও কাজ করেছেন একতা৷ সারা দেশে প্রায় ১৫ টি নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত তিনি৷ সিঙ্গাপুরে দর্পণ আয়োজিত মিউজিক ফেস্টিভ্যালের পোস্টারও তাঁর হাতে আঁকা৷ সত্যজিৎ রায় রেট্রোস্পেক্টিভের পোস্টারও একতার ভাবনাপ্রসূত৷ ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁদের কাজ প্রতিনিয়ত প্রেরণা দেয় একতাকে, তাঁরা হলেন ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়, মীর আফসার আলি, পৌলমী বসু এবং অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ এঁদের কাজ করা দেখতে দেখতেই নিজে চলার পথ খুঁজে নিয়েছেন তিনি৷
ডিজিটালের সঙ্গে পাল্লায় হাতে তৈরি অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে৷ একতার লড়াই সেই যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে৷রঙ-তুলিকে মাধ্যম করে ধরে রেখেছেন অতীতের হাতে তৈরি পোস্টারের ঘরানা৷ যখন ডিজিট্যাল পোস্টারের রমরমা তখন হাতে আঁকা পোস্টারে একতার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের৷