নয়া সরকারি নির্দেশিকায় স্বস্তিতে ওলা-উবার, যদিও কাটলনা সংশয়
অনলাইন ট্যাক্সি এগ্রিগেটর সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নির্দেশিকা স্বস্তি দিল ওলা, উবার এর মত সংস্থাগুলিকে। কিন্তু আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আমরা যেমনটা উল্লেখ করেছিলাম যে, রাজ্য সরকারের এক্তিয়ার রয়েছে নিজেদের রাজ্যের জন্য নিজস্ব নির্দেশিকা চালু করার, যা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এর ফলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে ট্যাক্সি সংস্থা গুলিকে। ওলা, উবারের মত সংস্থাগুলি নতুন নীতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই কিছু ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে তাদের ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
এই মাসের গোড়ার দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক পরিবহণ ও রাজপথ সংক্রান্ত দফতর (Union Ministry of Road Transport and Highways ) ‘অ্যাডভাইসরি ফর লাইসেন্সিং, কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড লায়াবিলিটি অফ অন-ডিমান্ড ইনফরমেশন টেকনলজি বেসড ট্রান্সপোর্টেশান প্লাটফর্ম’ শীর্ষক একটি নথি প্রকাশ করেছে। এই নথিতে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আমরা ইয়োরস্টোরিতে প্রকাশিত আমাদের প্রবন্ধে দেখিয়েছিলাম, সেগুলির উল্লেখ থাকলেও সংস্থাগুলির কাছে সবথেকে বড় সুবিধার বিষয় হয়েছে এটাই যে এতদিন পর অবশেষে এই নথিতে টেকনলজি বেস্ড এগ্রিগেটরের সাথে সাধারণ ট্যাক্সি কম্পানির ফারাক করা হয়েছে। ওলা এবং ঊবার – এই দুই সংস্থাই জানিয়েছে যে উভয়েই হল মূলত মোবাইল টেকনলজি প্লাটফর্ম যা গ্রাহকদের ট্যাক্সি বুক করতে এবং ওলার ক্ষেত্রে ট্যাক্সির পাশাপাশি অটো বুক করতে সহায়তা করে।
এই দুই সংস্থাই বর্তমানে জানিয়েছে ভারতে ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে তারা সেটা নিতে প্রস্তুত।
ওলা কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। “আমরা সরকারের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করব এবং সরকারি নির্দেশিকা মেনে আমরা কোটি কোটি মানুষের কাছে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজলভ্য করে তোলার লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাব,” – এমনটাই উল্লেখ করার হয়েছে এই বিবৃতিতে।
উবার ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট অমিত জৈন জানিয়েছেন, “এই নির্দেশিকা ইতিবাচক অর্থে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।এখানে যথাযথভাবেই ট্যাক্সি অপারেটরের সাথে টেকনলজি প্লাটফর্মের ফারাক রাখা হয়েছে এবং আমাদের নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক পরিসরের কথা মাথায় রেখে এই পরিসরের উপযুক্ত নির্দেশিকা জারি করা
হয়েছে”।
সংশয় থেকে যাচ্ছে রাজ্য সরকারের নীতি নিয়ে -
ওলা এবং উবার – উভয় সংস্থাই ইয়োরস্টোরিকে জানিয়েছে যে তারা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সানন্দে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।“আমরা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের শর্ত মেনে এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করার প্রচেষ্টা করব যাতে সেই ব্যবস্থা আমাদের সাথে যুক্ত সমস্ত মানুষের উন্নতি, তাদের উদ্যোগের সাফল্য এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে,” বললেন ওলা’র সিনিয়র ডিরেক্টর, মার্কেটিং কমিউনিকেশান্স দফতরের সিনিয়র ডিরেক্টর আনন্দ সুব্রমনিয়াম। তিনি ইয়োরস্টোরিকে আরো জানালেন যে লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়ে ওনাদের সংস্থার কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু রাজ্য পরিবহন দপ্তরের উলিখিত অনেকগুলি নির্দেশ নিয়ে এই দুই সংস্থার কর্তারাই তাঁদের সংশয়ের কথা ইয়োরস্টোরিকে জানিয়েছেন।
দিল্লিতে CNG সংক্রান্ত জটিলতা -
এমনই একটি বিষয় হল রাজধানী শহরে চলা সমস্ত ট্যাক্সির ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসাবে বাধ্যতামূলকভাবে CNG ব্যবহারের নির্দেশিকা। বিগত কয়েকমাসে ওলা তাদের সংস্থার সমস্ত গাড়িকেই CNG চালিত গাড়িতে পরিণত করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এমনকি কোন গাড়ি নেওয়া হবে, ওলার টেকনলজি প্লাটফর্ম সেটা ঠিক করে গাড়ির জ্বা্লানির নিরীখে, জানালেন আনন্দ। দিল্লি শহরে কেউ ওলার পরিষেবা নেওয়ার জন্য আবেদন জানালে, সেক্ষেত্রে CNG চালিত গাড়িই ব্যবহার করা হবে। দিলি এবং দিল্লী থেকে এনসিআর এর ক্ষেত্রে ওলার অ্যাপ’এ পছন্দমত গাড়ি বাছাই করার ব্যবস্থা রয়েছে( দিল্লি থেকে এনসিআর এর ক্ষেত্রে CNG এর পাশাপাশি ডিজেল চালিত গাড়িও পাওয়া যায়)। এছাড়া দিল্লির সমস্ত চালককেই তাঁদের গাড়ি ডিজেল ইঞ্জিন থেকে CNG চালিত ইঞ্জিনে বদলে ফেলার ক্ষেত্রে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ওলা ইতিমধ্যেই বিবিধ বিনিয়োগ সংস্থা, গাড়ি নির্মাতা সংস্থা এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশানের মত CNG উৎপাদক সংস্থার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলেছে।
কিন্তু দিল্লির মত অন্যান্য রাজ্যেও CNG বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হলে, সেটা সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, এমনটাই জানালেন ওলার একজন এক্সিকিউটিভ। CNG চালিত গাড়ি এবং তার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব অনেক রাজ্যের ক্ষেত্রেই বাস্তব সমস্যার বিষয়। যেমন, বেঙ্গালুরুতে বর্তমানে কোনো CNG স্টেশান নেই।
এই মাসের গোড়ার দিকে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে জারি করা এক নির্দেশিকায় সমস্ত ট্যাক্সিকে CNG চালিত করে ফেলার জন্য ২০১৬ এর পয়লা মার্চ অবধি সময় দেওয়া হয়েছে। উবার জানিয়েছে যে তারা দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করছে। “পয়লা মার্চের মধ্যে সমস্ত গাড়িকে CNG চালিত করার জন্য আমরা কি পদক্ষেপ নিচ্ছি, কি পরিকল্পনা করেছি, সেইসবকিছু দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি এফিডেভিট মারফত কোর্টকে জানাতে হবে। ডিজেল চালিত ট্যাক্সি চালাবার অনুমতি চেয়েও আমরা কোর্টের কাছে আমাদের মতামত জানাতে পারি – অন্তিম পর্যায়ের শুনানির সময়েয়ে কোর্ট আমাদের বক্তব্য শুনবে,” জানালেন উবার এর মুখপাত্র।
পিক-টাইম চার্জ –
কেরালার পরিবহণ দফতর ইয়োরস্টোরিকে জানিয়েছে যে, তারা ন্যূনতম ভাড়া বাড়িয়ে ‘পিক-টাইম চার্জ’ তুলে দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। কিন্তু ওলার এক কর্তা এর বিরোধিতা করছেন এই মর্মে যে, টুরিস্ট ট্যাক্সির ভাড়া সংক্রান্ত নিয়মাবলী আরোপ করার এক্তিয়ার কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের রয়েছে, রাজ্য সরকারের নেই। আর কেরালায় ওলার যেসমস্ত ট্যাক্সি রয়েছে, সেগুলি টুরিস্ট লাইসেন্সেই চলছে(কারণ তিরুঅনন্তপুরম বা কোচি শহরে পরিকাঠামোর সরকারি পরিকল্পনায় ট্যাক্সি পরিষেবার সুযোগ দেওয়া নেই)।
এদিকে কর্ণাটক সরকার জানিয়েছে যে, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হলে সেক্ষেত্রে চালকের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ট্যাক্সি সংস্থার যুক্তি যে, তাদের কাছে যে লাইসেন্স রয়েছে, সেটা রেডিও ট্যাক্সি বা টুরিস্ট ট্যাক্সির লাইসেন্স নয়। বরং তাদের যেটা রয়েছে সেটা হল ‘ক্যারেজ পারমিট’ যাতে গ্রাহকের সাথে ভাড়া নিয়ে দরদাম করবার সুযোগ দেওয়া রয়েছে। “অর্থনীতির একদম গোড়ার শিক্ষাই হল যে মূল্য নির্ভর করে চাহিদা ও যোগানের উপর। এখন যদি ভাড়া বেঁধেও দেওয়া হয়, তাহলেও সেক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে ভাড়া বাড়তে বাধ্য,” জানালেন এক ট্যাক্সি সংস্থার একজন কর্তা।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ট্যাক্সিচালকরা -
কিন্তু শুধুমাত্র এই বিষয়গুলিই যে ট্যাক্সি সংস্থাগুলিকে ভাবাচ্ছে, এমনটা কিন্তু নয়। সাধারণ ট্যাক্সির সাথে ওলার-উবারের ট্যাক্সির পার্থক্য হল যে এগুলিকে ডাকতে হলে অ্যাপের সাহায্যেই ডাকতে হবে। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ডাকা সম্ভব নয়। এছাড়াও, এই সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বা পার্কিং এর জন্য নির্দিষ্ট জায়গার সুবিধা প্রযোজ্য নয়। উবারের ট্যাক্সিগুলিকে সরকারিভাবে দেখা হয় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যবহৃত গাড়ি হিসাবে, জানালেন উবার এর দক্ষিণ এশিয়া ও ভারতের কমিউনিকেশান্স লিড কারুণ আর্য। “চুক্তি অনুসারে, এই গাড়িগুলিকে অ্যাপ এর মাধ্যমে বুক করার পরিষেবা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে উবার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশান পায়,” জানালেন তিনি।
কিন্তু এই ধরনের যুগান্তকারী ব্যবসায়িক পরিকল্পনার ফলস্বরুপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় ট্যাক্সি ড্রাইভাররা।“নিজেদের গ্রাহকসংখ্যা বাড়াবার জন্য ওলা কিংবা উবার অনেক কমে – কিলোমিটার প্রতি ৮-১০ টাকা হারে পরিষেবা দেয়। কারণ এদের পিছনে রয়েছে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা্র পুঁজি। কিন্তু আমাদের পক্ষে এত কম টাকায় গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। আমাদের বাঁধা ভাড়া হল কিলোমিটার প্রতি ১২ থেকে ১৪ টাকা,” বলছিলেন মুম্বাই এর ‘স্বাভিমান ট্যাক্সি-রিকশা ইউনিয়ন’ এর প্রেসিডেন্ট কে কে তিওয়ারি। মুম্বাই ট্যাক্সিম্যান’স অ্যাসোসিয়েশানের সাথে মিলে যৌথভাবে এই স্বাভিমান ইউনিয়ন তাদের নিজেদের একটি অ্যাপ তৈরি করার কথা বিবেচনা করছে।“কিন্তু ওলা বা উবারের পিছনে যেহেতু কোটি কোটি টাকার মূলধন রয়েছে, তাই আমাদের পক্ষে ওই সংস্থাগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়,” এমনটাই জানালেন তিওয়ারি। তিনি আরো জানালেন যে, সাধারণ উপায়ে যাত্রী পেতে সমস্যা হচ্ছে বলে আজকাল অনেক ট্যাক্সিচালকই ওলা বা উবারের মত সংস্থাগুলির সাথে গিয়ে যুক্ত হচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকায় এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে “ট্যাক্সির মালিকের আপত্তি না থাকলে কোনো ট্যাক্সিচালককেই মাল্টিপল অন-ডিমান্ড ট্রান্সপোর্টেশান টেকনলজি প্লাটফর্মের সাথে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে কোনোরকম ভাবে বাধা দেওয়া যাবেনা,”। অনেক চালক ইতিমধ্যেই এই সংস্থাগুলির সাথে যুক্ত হচ্ছেন এবং দিনে রাতে বিভিন্ন সময়ে বুকিং অনুযায়ী এই সংস্থাগুলির হয়ে ভাড়া খাটছেন।
ইয়োরস্টোরি যা ভাবছে –
রাজ্য সরকারগুলির অবিলম্বে এগ্রিগেটরদের প্রসঙ্গে নিজস্ব নির্দেশিকা জারি করা উচিত। কারণ সংস্থাগুলির ব্যবসার ক্ষেত্রে অথবা এই সংস্থার সাথে যুক্ত চালকদের ও সংস্থাগুলির থেকে পরিষেবা নেওয়া গ্রাহকদেরও দিক থেকে দেখলেও এই অনিশ্চয়তা অভিপ্রেত নয়। নির্দেশিকা জারি হয়ে গেলে ভাড়ার হেরফের বা পিক টাইম চার্জ সংক্রান্ত যেসব বিষয়ে রাজ্যের সাথে সংস্থাগুলির বিরোধ দেখা দিচ্ছে, সেইগুলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসবে। যেহেতু ‘পিক আওয়ার’ এর ক্ষেত্রে বেশি ভাড়ার ব্যবস্থা চালু রাখার মধ্যে দিয়েই ব্যস্ত সময়ে বেশি চালককে কাজে লাগানো এবং অধিক লাভ করা সম্ভব হয়, তাই সরকার পিক-চার্জ এর ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলে ওলা বা উবার সমস্যায় পড়তে পারে। কিন্তু এই ধরনের সংস্থা, যারা বাজারের দখল নেবার জন্য পরস্পরের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে, তাদের যেহেতু নিজেদের চালকদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ও ইনসেনটিভ দিতে হয়, তাই তাদের পক্ষে আর কতদিন ভর্তুকি দিয়ে কম মূল্যে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে, সেটাই হল আসল প্রশ্ন। এবং সংস্থাগুলি ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করে দিলে কতজন গ্রাহক এই সংস্থাগুলির থেকে পরিষেবা নিতে আগ্রহী হবেন, ভাবার বিষয় সেটাও।