পারস্যের আতরের যতই নাম ডাক থাক। গন্ধবণিকদের নিজের দেশ ভারত। সাতবাহন রাজাদের আমলে এদেরই প্রাধান্য ছিল। ভারতের প্রাচীন সভ্যতায় গন্ধবণিকদের দানের নিদর্শনও অনেক। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রধান প্যাট্রোনদের একটা অংশই ছিল এই গন্ধবণিকরা। ভারতের ফুলের গন্ধ নিয়ে এরা যেতেন দেশে দেশে। বিক্রি হত গোটা ইউরোপে। আর এখন প্যারিসের পারফিউম নিয়েই আমাদের যত আদিখ্যেতা। জানবেন প্যারিসের সেই অমোঘ পারফিউমও তৈরি হয় ভারতীয় উপকরণ দিয়ে। প্রাচীন গন্ধবণিকদের এক বংশধর এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরে নিজেকে আর থামিয়ে রাখতে পারেননি। শুরু করেছেন নিজের গন্ধ বেচার ব্যবসা। নাম মনন গান্ধী। এই পদবী গান্ধী আসলে গন্ধবণিক এই উপাধিরই পরিণত রূপ। সেই সত্যই ওকে ওর শিকড়ের দিকে টেনেছে।
সুগন্ধি নিয়েই মননের দীর্ঘদিনের পারিবারিক কারবার। সুগন্ধি তৈরির জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠানোর দীর্ঘদিনের ব্যবসা তাঁদের। গত পাঁচ বছর ফ্রান্সেই ছিলেন। একদিন মনে হল, ভারত থেকেই উপকরণ যায় বিদেশে অথচ কেন যুগের সঙ্গে তাল মেলানো কোনও দেশি ব্র্যান্ড নেই? দু বছর আগে কিছু স্যাম্পল হাতে পান। কয়েকশো বার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর গত অক্টোবরে নিজেদের ব্র্যান্ড বাজারে নিয়ে আসেন। ৬ মাস ধরে বাজারে রয়েছে ওদের ব্র্যান্ড, শুরুর গল্প বলছিলেন মনন।
বিদেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাজারে টিকে থাকার সাহস দেখিয়েছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। মনন মনে করেন, দিন পাল্টেছে। তরুণ প্রজন্ম দেশি ব্র্যান্ডকে সুযোগ দিতে আগ্রহী। ভালো মান ধরে রাখতে পারলে বাজারে টিকে থাকা সম্ভব। লেমন, উডি, জিনজার, টিউব রোজ, জেসমিন, ব্ল্যাক পেপার এমন ৮ ধরনের ফ্লেভারে পাওয়া যাচ্ছে বম্বে পারফিউমারি। ওরা চেয়েছিলেন দেশি চালু উপকরণের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল ঘটাতে। গন্ধ নেওয়ার পর যাতে মনে হবে এমন সুগন্ধি আগে কখনও শুঁকে দেখেননি আপনি। অর্থাৎ একটা স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।
দেশি ব্র্যান্ড হলেও মনন জানাচ্ছেন,তাঁদের সুগন্ধি তৈরি হয় আসলে ফ্রান্সে। সেখানকার প্রযুক্তি ব্যবহার করাটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। তবে বোতল-বন্দি করা এবং প্যাকেজিং হয় ভারতেই। শহরের নামে ব্র্যান্ডের নাম রাখলেও মুম্বাই নয়, পুরনো বম্বে নামই রেখেছেন কেন? তার পেছনেও রহস্য আছে। ‘অনেক দিন আগে বম্বে পারফিউমারি প্রোডাক্ট নামে সংস্থা খুলেছিলেন বাবা। নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় সেটি। আমি যখন নিজের সংস্থা শুরু করতে চলি তখন মনে হল বাড়ির পুরনো ঐতিহ্য বজায় রাখি। আমার সংস্থার সঙ্গে পারিবারকে জুড়ে নিই। আমিও বম্বের ছেলে। মুম্বাই আমার প্রিয় শহর। তাই নাম পছন্দ করতে দুবার ভাবিনি। তাছাড়া বম্বে পারফিউমারি নাম শুনতেই সবাই বুঝে যাবে দেশি ব্র্যান্ড। আলাদা করে বলে দিতে হবে না। যারা দেশি ব্র্যান্ড পছন্দ করেন সেই অংশটাকে তো আমরা সঙ্গে পাবোই’, বিজনেস স্ট্র্যাটেজি বোঝাচ্ছিলেন মনন। তবে মননের লড়াইটা সহজ নয়, জানেন নিজেও।‘দেশের মাটিতে বিদেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে লড়াই আমার। শুধু তাই নয় ক্রেতাদের দেশি ব্র্যান্ডের দিকে টেনে আনতে বাড়তি কিছু দরকার। ক্রেতার মন বুঝে সেটাই করার চেষ্টা করেছি। বাছা বাছা শহরে প্রোডাক্ট লঞ্চ করছি। আশা করি চৌরঙ্গীর দ্য স্পেস অ্যাট নাইন বাই টু পছন্দ হবে ক্রেতাদের’, আশাবাদী তরুণ উদ্যোক্তা।
মনন বলেন, আমাদের দেশে সব আছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ। পরিকাঠামোয় হয়ত খানিকটা পিছিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতেও উন্নতি হবে। দেশের মাটিতে দেশি ব্র্যান্ডে ভরসা তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই। মনন চান তাঁর মতো আরও অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসুন, সাহস আর বিশ্বাসে ভর করে নেমে পড়ুন ব্যবসায়। অধ্যবসায় থাকলে সফল হবেই।