ছিন্নমূল এক শিল্পীর জগৎ জয়ের গল্প
নভেম্বরের গোড়ার দিক। শীত আসব আসব বলে উসখুস করছে। এমনই একদিন দুপুরে বর্ধমান জেলা প্রশাসনের তরফে খবরটা পেলেন ধ্রুব শীল। ভারত সরকার তাঁকে শিল্পগুরু পুরস্কার দিচ্ছে। এই খবরে আচমকাই চনমনে হয়ে উঠল আদতে তরঙ্গহীন বর্ধমান শহরের ইছলাবাদ কলোনি। এই এলাকায় থেকেই তাঁর দীর্ঘ ৬ দশকের শিল্পীজীবন। তবে এটা তাঁর প্রথম খেতাব নয়। দেশ বিদেশে বহু সম্মান ও খেতাবের পাশাপাশি ১৯৯৬ সালে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে এই দীর্ঘ পথ চলার পিছনে রয়েছে আরেক দীর্ঘ আখ্যান।
১৯৩৬ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশের বড়িশালে জন্ম ধ্রুব শীলের। তাঁর ছোটবেলা কাটছিল আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই। কিন্তু ৪৬-এর দাঙ্গা তাঁকে ভিটেছাড়া করে। পূর্ববঙ্গের মায়া ত্যাগ করে তিনি ও তাঁর পরিবার চলে আসেন এপাড় বাংলায়। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে তাঁরা থিতু হন বর্ধমানের ইছলাবাদে। কেন না দেশভাগের পর বড়িশালের ছিন্নমূল মানুষগুলির একটা বড় অংশই ঠাঁই পেয়েছিলেন এখানে। কিন্তু ঠাঁই না হয় হল, পেট চলবে কী করে? ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে কাঠের কাজ শিখেছিলেন। জীবন সংগ্রামে সেই শিক্ষানবীশিই কাজে দেয়। সেই শুরু। এরপর আজও ধ্রুব শীল আর কাঠের গাঁটছড়ার বাঁধন আলগা হয়নি। কাঠের কাজের প্রথাগত ধারা ও আঙ্গিকে পরিবর্তন এনে ক্রমেই নিষ্প্রাণ, শুষ্ক কাঠে প্রাণ সঞ্চার করতে থাকেন শিল্পী। শুরুর দিকে কাঠের পুতুল, ঘোড়া গড়লেও আচমকাই একদিন তাঁর শিল্পীমন তৈরি করে ফেলে একটি পেঁচা। আদতে ‘শ্রীহীন’ এই পেঁচাই তাঁকে শিল্পীর স্বীকৃতি দেয়। শহর বর্ধমান ছাড়িয়ে জেলা-রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায় ধ্রুব শীলের পেঁচা। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ক্রমে দুর্গা, হর-পার্বতী, গণেশ, গজসিংহ-চওড়া সেগুন-গামারের কাঠে সুক্ষ্ম নকশা ফুটিয়ে দেব-দেবীদের জাগিয়ে তোলেন ধ্রুব শীল। শুধু সেগুন কিংবা গামার নয় – মূল্যবান চন্দন কাঠের ওপর ধরা দিয়েছে তাঁর গড়া নানা শিল্পকীর্তি। বলা বাহুল্য এহেন শিল্পের সমঝদারেরও অভাব হয়নি। দেশ-বিদেশের নানা স্থানে শিল্পীর এক একটি ভাস্কর্য বিকোয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দরে। হিন্দু আধ্যাত্মিকতার নিরিখে শিল্পীর গড়া দুর্গা, হর-পার্বতীরা এখন বাক্সবন্দি হয়ে অস্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার পক্ষপাতী তিনি। তাই এক দশক আগেই নিজের বাড়িতে গড়েছেন প্রায় ২ হাজার ফুটের অত্যাধুনিক ওয়ার্কশপ। সেখানে কাঠ চেরাই থেকে পালিশ সমস্তই হয় যন্ত্রে। শিল্পীর কথায় শিল্পদ্রব্যের গুনমানের দিকে খেয়ার রাখাটা দরকার। এজন্যই নকশা কিংবা ভাস্কর্যের মৌলিকত্ব তো বটেই, গুনমানটাও তাঁর শিল্পকর্মের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট। যার টানে দেশের মধ্যে দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে তো বটেই সুদূর ইটালিতেও তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী দেখতে লোক জমে যায়।
জীবনভর নিজে যেমন একের পর এক শিল্পসৃষ্টি করেছেন, তেমনই অসংখ্য মানুষকে শিখিয়েছেন দারুশিল্পের পাঠ। এখনও পর্যন্ত ১০০০ জন তাঁর কাছে এই শিল্পের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর শেখানো পথে আজ অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। আগামী দিনেও এই পথে হেটে কেউ হয়তো জাতীয় খেতাব ঘরে তুলবেন। তেমনটাই স্বপ্ন দেখেন ধ্রুব শীল। আচমকাই অশক্ত হাতে শিল্প গড়তে গড়তে খানিকটা আবেগঘন গলায় বলে ওঠেন, ‘পাইতাম যদি তগো মতো বয়সটা, তৈলে দেখায়া দেতাম আরও কী করতে পারি’। এর পরক্ষণেই ছিয়াশির যুবকের মুখে বিজয়ীর হাসি ঝিলিক দিয়ে যায়।