বর্ধমানের পল্লীবধূর উদ্যোগপতি হওয়ার কাহিনি
এ এক অন্য লড়াইয়ের কাহিনী। হার না মেনে ডুবতে থাকা তরীর হাল ধরে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসা এক সাহসিনীর কাহিনী। যে কাহিনী নতুন উদ্যোগপতিদের অবশ্যই প্রেরণা দেবে। আর সাহস দেবে সেই সব মানুষদের যারা সব হারিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকেন। বর্ধমানের কুড়মুনের ব্রততী ব্যানার্জীর সেই কঠিন লড়াই আমাদের নতুন করে ভাবনার ইন্ধন দেয়।
স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ ব্যানার্জী, স্ত্রী ব্রততী ও ৫ বছরের মেয়ে অদিতিকে নিয়ে ছোট্ট সুখের সংসার। তখন ২০০৪ সাল। বর্ধমান হাসপাতালের সামনে জ্যোতিপ্রকাশ বাবুর খুচরো ওষুধের দোকান। দোকানের রোজগার থেকে সংসার মোটামুটি ঠিকই চলছিল। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই জীবনে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। রাজনীতির শিকার হন জ্যোতিপ্রকাশ বাবু। বন্ধ হয়ে যায় তাঁর দোকান। সঞ্চিত অর্থ শেষ হয়ে স্ত্রী, কন্যাকে নিয়ে পথে বসার উপক্রম। স্বামীর এই দুঃসময়ে সংসারের হাল ধরলেন ব্রততী। শুরু হল জীবন সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায়।
মাত্র ২০০ টাকা পুঁজি নিয়ে বাড়িতে জোয়ানের আরক তৈরি শুরু করলেন। সেই জোয়ান ছোট ছোট প্যাকেটে ভরতেন। আর তাঁর স্বামী সেগুলি সাইকেলে করে বিক্রি করতেন বিভিন্ন হোটেলে। দিনে দিনে সুস্বাদু এই জোয়ানের চাহিদা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন দোকান থেকেও অর্ডার আস্তে শুরু করে। ব্রততী দেবীর চেষ্টায় সংসারের ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কিছুটা আলোর রেখা ফুটে ওঠে। এযেন দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাওয়া জলবৎ তরলং গল্প। সিনেমরা মত। কিন্তু জীবন তো সিনেমা নয়। তাই লড়াই টা কয়েক ঘন্টায় শেষ হয়ে যায় না। নিত্যদিন লড়তে হয়। ওষুধের দোকানদার রীতিমত মধ্যবিত্ত মানুষকে, শ্রেণি খুঁইয়ে, বিত্ত খুইয়ে, মান সম্মান ছোটো কাজ বড় কাজের ভেদ না রেখে সাইকেলে এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে জোয়ান ফেরি করে বেড়ানোর ভিতর যে সংগ্রাম লুকিয়ে আছে তার কথা একবাক্যে কেন, পাতার পর পাতা লিখলেও সুবিচার করা হয় না। কিন্তু এই জ্যোতিপ্রকাশের জ্বলে ওঠার ইন্ধন তাঁর স্ত্রী।
অল্প অল্প করে পয়সা জমিয়ে ২০০৯ সালে নিজের এলাকাতেই ৯ কাঠা জায়গা কেনেন। ব্যবসা বড় করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। মেয়ের নামে নতুন প্রতিষ্ঠান খোলেন। নাম দেন ‘অদিতি মহিলা উদ্যোগ’। প্রধানমন্ত্রী এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রামের অধীনে ১০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন নতুন ব্যবসা। তার ৯ কাঠা জায়গায় কারখানা করেন। নতুন মেশিন বসান। সেই মেশিনে বেসন, ছাতু, আটা, বিভিন্ন রকম রান্নার মশলা তৈরি করতে শুরু করে দেন ব্রততী। নিজস্ব ব্রান্ডে বিভিন্ন মাপের প্যাকেজিং করে বাজারে বিক্রি শুরু হয়। বেশ কয়েকজন কর্মী নিয়োগ করেন। তাদের বেশিরভাগই মহিলা। এতদিন বাজার খুঁজতেন ব্রততীরা, এখন বাজারই খোঁজে তাঁদের প্রোডাক্ট। স্বামীর পাশে দাঁড়াতে এসে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গ্রামের এক গৃহবধূ হয়ে উঠলেন উদ্যোগপতি।
অভাব দূর হয়ে আর্থিকভাবে অনেকটাই স্বাবলম্বী কুড়মুনের ব্যানার্জী পরিবার। শুধু নিজেরাই নয়, পাশাপাশি তাঁদের ছত্রছায়ায় সম্মানের জীবন পেয়েছেন স্থানীয় দুঃস্থ মহিলারাও। ঋণ প্রায় শোধ করে ফেলেছেন। স্বামীর দুঃসময়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে প্রমাণ করেছেন যে মহিলারা চাইলে কঠিন ব্রতেও দক্ষ ব্রতী হতে পারে।