‘ইয়েলো বাল্ব’। ব্যবসায়ীদের জন্য কোনও নতুন ভাবনার পীঠস্থান। আবার ব্যবসা চলার পথে আসা সমস্যাকে টপকে যাওয়ার মুশকিল আসানও। এমন এক জায়গা যেখানে ভাল ভাবনা , আরও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিলিত হয়। নিজের হাতে তৈরি সংস্থা সম্বন্ধে এমনই মনে করেন নেহাল মোদি।
মুম্বইয়ের কাটচি ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম হয় নেহাল মোদির। তবে মুম্বইয়ের মেয়ে হলেও তাঁর স্কুল জীবন কেটেছে কলকাতায়। কলকাতার সেন্ট থমাস স্কুলের প্রাক্তনী নেহালের কাছে স্কুল জীবন ভীষণভাবে স্মরণীয়। কারণ তাঁর জীবনসঙ্গীকে এই স্কুল জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। আর এই মানুষটির হাঠাৎ করে তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়াই তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন নেহাল। নেহালের জীবনে তাঁর স্বামীর একটা বিশাল প্রভাব আছে। জীবনের উৎরাই চড়াইতে সবসময় তাঁকে পাশে পেয়ে এসেছেন নেহাল। সিএ পরীক্ষায় বিফল হওয়ার মত ধাক্কাও তিনি সামলে উঠেছিলেন হবু স্বামীর অনুপ্রেরণাকে সঙ্গী করেই। স্বামীর উৎসাহে সিএ পরীক্ষার গণ্ডী একসময়ে পার করতে সমর্থ হন তিনি। সিএ পাশ করার পরই হন্যে হয়ে একটা ভাল চাকরির খোঁজ শুরু করেন। এরমধ্যেই সাতপাকে বাঁধা পড়ে কলকাতা ছেড়ে চেন্নাই পাড়ি দিতে হয়। সেখানেও ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি চেয়ে ‘কোল্ড কল’ করতে থাকেন তিনি। কথায় বলে মনেপ্রাণে কোনও চেষ্টা কখনও বিফল হয়না। নেহালের জীবনেও তাই হল। তিন মাস একটানা চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যে একসঙ্গে তিনটে চাকরি জুটে যায় নেহালের। সে আরও এক সমস্যা। অবশেষে আমেরিকান ব্যাঙ্কের চাকরিটাই বেছে নেন নেহাল। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমেরিকান ব্যাঙ্ক ছেড়ে এবিএন অ্যামরো। সেখান থেকে সিটি গ্রুপে চাকরি।
চাকরি জীবন ভালই কাটছিল। কিন্তু সমস্যার শুরু হল সন্তানের জন্মের পর। বাচ্চাকে সময় দেওয়া ও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাকরি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাহলে কী করা যায়? কয়েকশো কাপ কফি সহযোগে বেশ কয়েকদিনের আলাপ আলোচনার পর নেহাল আর তাঁর স্বামী ঠিক করলেন, বাচ্চা যতদিন না কিছুটা বড় হচ্ছে ততদিন নেহাল কর্পোরেট জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। সময় দেবেন নিজের সন্তানকে। কিন্তু মনেপ্রাণে ব্যবসায়ী নেহাল এভাবে বসে থাকার পাত্রী নন। ফলে শুরু হল ভাইয়ের সঙ্গে বসে মার্কেটপ্লেস মডেলে বাচ্চাদের আসবাব বিক্রির পরিকল্পনা। তবে সে পরিকল্পনা বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু এই মার্কেটপ্লেস মডেলই তাঁকে মনের মতো কাজের ঠিকানা যোগাড় করে দিয়েছিল।
মার্কেটপ্লেস মডেলকে হাতিয়ার করে বিটুবি বা বিজনেস টু বিসনেস মার্কেটিং শুরু করলেন নেহাল। নাম দিলেন ‘ইয়েলো বাল্ব’। যা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মিডিয়া হাউস , সকলের জন্য নতুন ভাবনার যোগান দেবে। শুরু হল এক নতুন জীবন। মার্কেটপ্লেস মডেলকে সামনে রেখে এক শিল্পোদ্যোগীর পথচলা। কিন্তু এই পথচলায় শুরু একজন ব্যবসায়ী হয়েই কাটান নি নেহাল। চলার পথে তাঁকে কখনও মা, কখনও শিল্পোদ্যোগী, কখনও নেতা, তো কখনও মুশকিল আসানের ভূমিকায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথাই ইয়োর স্টোরির সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন নেহাল মোদি।
মা - যমজ সন্তানের মা নেহাল। সন্তানদের জন্মের পরই ফের ২০১২-তে কাজে ফেরেন তিনি। কিন্তু তাঁর মেয়ের একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা তাঁর দুনিয়াটাই বদলে দেয়। ‘কেন তুমি আমার নতুন স্কুল থেকে আমায় নিতে আসনা’? মেয়ের এই সরল প্রশ্ন নেহালকে এতটাই ছুঁয়ে গেল যে স্বামীর সঙ্গে কয়েকদিন আলোচনার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর সন্তানদের নিয়ে কাটতে লাগল তাঁর দিন। তাঁদের স্কুল নিয়ে যাওয়া থেকে বন্ধুদের জন্মদিনে নিয়ে যাওয়া। পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া থেকে সাঁতারের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া। এসব নিয়ে দিনটা কিভাবে যে কেটে যেত তা এখন বুঝতে পারেন না নেহাল। যদিও এখন নেহাল স্বীকার করেন তাঁর সেদিনের সিদ্ধান্তটা নেহাতই আবেগপ্রবণ হঠকারিতা হয়ে গিয়েছিল।
শিল্পোদ্যোগী – নেহালের বিশ্বাস, নতুন ভাবনা একজন ক্রেতা বা বিক্রেতা, যে কারও কাছ থেকেই আসতে পারে। কিন্তু তা তখনই কাজের হয় যখন সেই ভাবনা নিয়ে কেউ উৎসাহিত হন। সেটাকে আরও সঠিক রূপ দিতে উঠে পড়ে লাগেন। ইয়েলো বাল্বের জন্ম এই উৎসাহ থেকেই। তবে এই ব্যবসায় ব্যবসায়ী বা ক্রেতাদের ক্ষেত্রে তাঁদের সারসংক্ষেপ ইয়েলো বাল্বে তোলার জন্য কোনও খরচ নেই। ইয়েলো বাল্ব তাদের এই মার্কেটপ্লেস মডেলের বিটুবি ব্যবসায়ে সলিউশন পার্টনারস বা বিক্রেতাদের কাছ থেকে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে থাকে। আর সেটাই তাঁদের মূল রোজগার।
প্রধান – নেহালের টিমে ছ’জন সদস্য। এই ছ’জন কর্মচারি নিয়েই তাঁর কাজ শুরু। তবে একজন প্রধান হিসাবে তাঁর টিমের দিকে নজর দেওয়া তাঁর একটি অন্যতম কর্তব্য বলে মনে করেন নেহাল। তাঁর মতে, ধরা যাক একদিন তাঁর কর্মচারিদের ২০ শতাংশই অসুস্থ। তখন কিন্তু একজন মালিক হয়েও তাঁর লাঞ্চ করার মত সময় হাতে থাকে না। নতুন শুরু হওয়া একটা সংস্থার ক্ষেত্রে টিমকে ভাল রাখার দিকে অতিরিক্ত সচেতনতার দরকার বলে মনে করেন নেহাল। তাঁর মতে, টিমের প্রতিটি সদস্যের এমন মনে হওয়া প্রযোজন যে তাঁরা বাড়িতেই আছেন। ব্যবসাটাকে তাঁদের নিজেদের ব্যবসা বলে মনে হওয়া জরুরি। দরকারে তাঁদের একদিন ছুটি দিতেও নেহালের কোনও আপত্তি নেই। যদি কারও মনে হয় কোনও দিন বাড়ি থেকেই সময় সুযোগমত অফিসের কাজ সারবেন, তাতেও তিনি রাজি বলেই জানালেন নেহাল। এমনকি কোনওদিন যদি কাজের চাপ কম থাকে তাহলে সেদিন অফিসেই বেশ একটা পিকনিক পিকনিক আযোজন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ছাত্র – তাঁকে ফের পড়াশোনায় ফিরতে হয়েছে। ব্যবসা করতে গিয়ে তাঁকে মার্কেটিংয়ে কার্যত মাস্টার্স করতে হয়েছে বলে জানালেন নেহাল। তবে এই চ্যালেঞ্জ যে তাঁকে একরকম দায় পড়েই নিতে হয়েছে তা তাঁর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা কষ্টহাসি থেকেই স্পষ্ট ছিল। ব্যবসাটাকে আরও ভালভাবে জানতে বই, ওয়েবসাইট, ব্লগ, কোনও কিছুই বাদ দেন নি নেহাল মোদি।
চ্যালেঞ্জ – তবে সব কিছুর পরও নেহালের দাবি তাঁর কাছে কঠিনতম কাজটা ছিল প্রায় শিক্ষানবিশের মাইনেতে সঠিক প্রতিভাকে কর্মচারি হিসাবে খুঁজে বার করা। যদিও ব্যক্তিগতভাবে এটাকে শোষণ বলেই মনে করেন নেহাল। তবে সেই সময় তাঁর সামনে আর কোনও রাস্তাও খোলা ছিল না, উপায়ও ছিল না। তখন এমন অবস্থা ছিল যে নেহালের পক্ষে সন্তান অসুস্থ বলে একটা দিন ছুটি নেওয়া সম্ভব ছিল না। এক দিনের জন্যও নিজের কাজ বা স্মার্ট ফোন থেকে নিজেকে দূরে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমনকি সংস্থার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সব দিকই সামলাতে হত তাঁকে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা –যদি ব্যবসা অনেক মানুষের কাজে লাগতে থাকে, স্থায়ী হয়, দ্রুত এগোনোর সম্ভাবনা থাকে এবং সর্বপরি ভাল অঙ্কের মুনাফা দেয়, তাহলে ২০২০ কে লক্ষ্য স্থির করে ছুটতে চান নেহাল। সব শর্তপূরণ হলে ইয়েলো বাল্বকে বিশ্বব্যাপী করে তুলতে চান তিনি। ২০২০-র এই লক্ষ্যে ছোটার পথে মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মত জায়গায় গিয়ে সরাসরি ক্লায়েন্টদের সঙ্গেও দেখা করতে চান নেহাল। তাছাড়া নতুন ও প্রতিভাবান একঝাঁক শিল্পোদ্যোগীকে প্রশিক্ষণও দিতে চায় ইয়েলো বাল্ব। সেইসঙ্গে মোবাইল অ্যাপের জামানার সঙ্গে তাল মেলাতে নিজের সংস্থার জন্য একটি অ্যাপও দ্রুত বাস্তবায়িত করতে চলেছেন আপাদমস্তক শিল্পোদ্যোগী নেহাল মোদি।