শৌনক-সুমনাদের 'পরশ'-এ দূর হচ্ছে অসাম্য
২০১১ সাল, পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গরীব ঘরের মেয়ে সাধনা আক্রান্ত হয় দূরারোগ্য রোগে, অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজন ছিল অর্থ। স্বাভাবিকভাবেই তা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না সাধনার বাবা মায়ের। সাধনার চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহে এগিয়ে এসেছিলেন কলকাতার কিছু তরুণ-তরুণী- শৌনক, কৌস্তভ, অনুপম, সুমনা, প্রদীপ। সঙ্গে ছিলেন আরও শুভানুধ্যায়ীরা। টাকা জোগাড় হয়েছিল, সুস্থ হয়ে উঠেছিল সাধনা। ভাবনার শুরুটা সেখান থেকেই। এরপরই শৌনকরা ঠিক করেন সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জন্য গড়ে তুলবেন এমন এক সংস্থা যা তাদের সম্মানজনকভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে, বিপন্ন হতে হবে না কোনও সাধনাকে। এভাবেই শুরু পরশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই দুটি প্রাথমিক জায়গাকেই বেছে নিয়েছে এই সংস্থা। বীরভূমের কামারপাড়া ও আশেপাশের গ্রামগুলিতে কাজ করে পরশ।
পুরো কাজটাই চলে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে। কিছু মানুষ নিয়মিত টাকা দিয়ে সাহায্য করেন, এবং আরও অনেকে নিজেদের সুবিধা মত টাকা দেন। ফান্ডিং ও লোকবলই সব থেকে বড় সমস্যা, জানালেন অনুপম। বললেন, “আমাদের এমন ডাক্তারদের প্রয়োজন, যারা মাসে বা প্রতি দুমাসে এক-দুদিন গ্রামে গিয়ে দরিদ্র মানুষদের চিকিত্সা করতে রাজি। এছাড়াও প্রয়োজন তরুণ ছাত্র ছাত্রী যারা শিক্ষা ও চিকিত্সা ক্ষেত্রে কাজে যোগ দেবে। আমাদের এই উদ্যোগে সামিল হওয়ার জন্য সবাইকেই স্বাগত”।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে রয়েছে প্রজেক্ট আরোগ্য ও প্রজেক্ট অমৃতা। প্রজেক্ট আরোগ্য চলছে গত আড়াই বছর ধরে। প্রতি দুমাসে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার শিবিরের আয়োজন করা হয়। সমস্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয় বিনামূল্যে। সংস্থার দাবি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রায় ৩,৫০০ রোগীর চিকিত্সা হয়েছে এই শিবিরে। অস্ত্রোপচার প্রয়োজন এমন রোগীদের জন্য রয়েছে প্রজেক্ট অমৃতা। পেডিয়াট্রিসিয়ান, কার্ডিওলজিস্ট, অপথ্যালমোলজিস্ট, ডেন্টিস্ট, গাইনোকোলজিস্টদের নিয়ে বিশেষ স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করা হয় এই প্রজেক্টে। কারোও অস্ত্রোপচার প্রয়োজন মনে হলে তাকে অন্য কোনও সংস্থা যারা সেই নির্দিষ্ট বিভাগে কাজ করে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়, যদি তা সম্ভব না হয় পরশের পক্ষ থেকেই টাকা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। পরশের স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ কর্মের মূল পরিচালক প্রদীপ মিত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্তমানে দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত।
সমাজের পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্য রয়েছে প্রজেক্ট অরণি। এই অংশের ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, ফলে তাদের জন্য প্রাথমিক স্তরে বিকল্প ও অভিনব শিক্ষা পদ্ধতি তৈরি করেছে পরশ। মূলত বাংলায় হলেও আদিবাসী পরিবার থেকে আসা ছাত্র ছাত্রীদের জন্য রয়েছে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছে এই প্রজেক্টে, পরশের শিক্ষা টিমের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছে আধুনিক শিক্ষার নানা পদ্ধতি। পুরো প্রজেক্টটি চলবে তিনটি স্তরে। পরশের শিক্ষা টিম তাদের শিক্ষা পদ্ধতির বিষয় প্রশিক্ষণ দেবে ইন্টার্নদের, ইন্টার্নরা গ্রামীণ স্কুলগুলির শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দেবে এই বিষয়, এবং শিক্ষিকারা সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে শিক্ষা দান করবেন। শিক্ষা সংক্রান্ত প্রজেক্টগুলির দায়িত্বে রয়েছেন কৌস্তভ ঘোষাল। কৌস্তভ আইআইটি হায়দ্রাবাদে এমএস করছেন।
প্রদীপ ও কৌস্তভ ছাড়াও সংস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছেন শৌনক দে, অনুপম ব্যানার্জি ও সুমনা বাসু। শৌনক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। পরশের মূল ভাবনা শৌনকের। অনুপম কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করে গবেষণা করছে আইআইটি খড়গপুরে। সুমনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমই করে বর্তমানে বহুজাতিক ব্যাঙ্কে কর্মরত। পরশের মূল টিম বলতে এই পাঁচজনই। এছাড়াও সংস্থার প্রথম দিন থেকে মেন্টর হিসেবে সঙ্গে রয়েছেন সুচন্দ্রা হাজরা, উদয় হাজরা ও ড. মধুমিতা বণিক রায় চৌধুরি।
সমাজের বেড়ে চলা অসাম্য দূর করার উদ্দেশ্যেই কাজ করছে পরশ। অনুপম বললেন, “আমাদের সমাজে অসাম্য ও বঞ্চনার একটা খুব খারাপ চক্র রয়েছে, গরীবরা আরও গরীব হয়ে চলে, বঞ্চিত থাকে জীবনের প্রাথমিক চাহিদাগুলি থেকে, বেড়েই চলে অসাম্য। এই অসাম্য দূর করারই পদ্ধতি ও কৌশলকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি আমরা, নাগরিক সমাজের উদ্যোগী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের থেকেই আসবে সেই পরামর্শ ও ভাবনা। আমরা আমাদের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই, যাতে আধুনিক তরুণ মন তাদের মেধা ও চিন্তাশক্তির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে বিকল্প শিক্ষার মডেল তৈরি করতে পারে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারবে এই তরুণরই।