কাদাজলে স্নান সেরে উঠে এল "আমার চেন্নাই"
অবশেষে! বন্যার জমা জল আমাদের রাস্তা থেকে নেমে গেল। কারেন্ট এসেছে। ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি পুরোদমে কাজ না করলেও কখনও আসছে কখনও যাচ্ছে, সব মিলিয়ে আমরা আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছি। এই ক’দিনে আমার একমাত্র পরিত্রাতা ছিল আমার মোবাইলের বিএসএনএল কানেকশান। অন্য সমস্ত নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেও মোবাইলের বিএসএনএল কানেকশান কিন্তু থমকে যায়নি। ঠিকঠাক ছিল। আর আরও আনন্দের ব্যাপার হল আমার মোবাইল ইন্টারনেটও পুরদস্তুর সঙ্গ দিয়ে গেছে। ফলে আমি বেশ কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি।
আমার এই অগ্নিপরীক্ষার প্রথম দিন থেকেই শুরু করা যাক, যে কঠিন পরীক্ষা কেবল আমাকে একা নয়, বরং গোটা শহরকেই দিতে হয়েছে। দুঃস্বপ্নের শুরু পয়লা ডিসেম্বর থেকে, আগের পর্বের মতোই প্রবল বর্ষণে ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসা রাস্তাগুলো যেদিন আবার ভেসে গেল। যদিও পরিস্থিতি তখনও একেবারে আয়ত্ত্বের বাইরে যায়নি। আমরা ক্রমশ রাস্তায় জমে থাকা জলে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম আর সেই জলের মধ্যে চোরা গোপ্তা গর্ত ও নর্দমা বাঁচিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রীও কিনে আনলাম। আমরা অশেষ ভাগ্যবান যে চেন্নাই শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় থাকার সুবাদে বুধবার রাতের আগে পর্যন্ত আমাদের এই তীব্র ও অবিরাম বর্ষণের বীভৎস নগ্ন রূপ দেখতে হয়নি। সেদিন পর্যন্তও আমার মোবাইল ডাটার হটস্পটকে আমার ল্যাপটপে জুড়ে শম্বুক গতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে tamil.yourstory.com এর খবর সম্পাদনা ইত্যাদি আমার প্রাত্যহিক কাজ কর্ম করে গেছি।
দিনটা ছিল দোসরা ডিসেম্বর বুধবার। আমি আমার কাজকর্ম শেষ করে সারাদিনের খবরের আপডেট নেবার জন্য খবরের চ্যানেল চালিয়ে বসলাম। খবরের চ্যানেলের আলোচনাচক্র গুলোতে তখন শহরের প্রান্তে মানুষের পুকুর ও জলাজমি ভরাট করে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করা এবং এখন এই প্রবল বর্ষণে জলবন্দী হয়ে থাকা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা চলছিল। বাড়িতেও আমাদের নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে অল্প বিস্তর আলোচনা হল আর আমিও তখন বললাম যে আজকাল মানুষ কিভাবে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই জলাজমি সংলগ্ন এলাকায় বাড়ি বা প্লট কিনে ফেলে ইত্যাদি। ঘুমে ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছিল, বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, তখনও জানিনা যে কি বীভৎস দুঃস্বপ্ন আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
সকাল ছ’টা নাগাদ গভীর ঘুমের মধ্যে আমার কানে কিছু বিক্ষিপ্ত শব্দ আসতে লাগলো, আমার বাবা চিৎকারের শব্দ, কয়েকটা পুলিশের গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ আর আমাদের পাশের বাড়ির মহিলার “জল জল” করে চিৎকার... তখনও আমি ভাবছি যে গত রাত্রের প্রবল বর্ষণের ফলে নির্ঘাত রাস্তায় কিছু জল জমে গেছে আর সেই দেখেই ওরা চেঁচামিচি করে খামোখা আমার কাঁচা ঘুমটার বারোটা বাজাচ্ছে! পরক্ষনেই শুনলাম আমার বাবা চিৎকার করছে, “ঘরের মধ্যে জল ঢুকে গেছে...” আমি তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে ছুটে গিয়ে দেখি পাশের বড় রাস্তা থেকে আমাদের গলিতে বানের তোড়ে জল ঢুকে আসছে। “এই জল কোত্থেকে আসছে?” এখন তো বৃষ্টিও হচ্ছেনা, কিছু বুঝতে না পেরে আমি এক ছুটে রাস্তায় চলে গেলাম আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের সঙ্গে দেখলাম যে হুহু করে জল এগিয়ে আসছে আর জলের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশে পাশের সমস্ত কিছু ক্রমশ জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছে। আমরা সকলে মিলে আমাদের গেটের সামনে বস্তা আর মাটি দিয়ে একটু উঁচু করে দিয়েছিলাম যাতে জল কম্পাউন্ডে না ঢুকতে পারে। এরকম বেশ কয়েক ঘণ্টা চলল আর তারপর কারেন্ট চলে গেল আর ফোনের সিগনালও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার পর আমাদের অঞ্চলে জল কিছুটা নামলো ও কয়েকজন ভাগ্যবানের বাড়িতে কারেন্ট এলো যার মধ্যে আমাদের বাড়ি একটা। এই প্রবল জলোচ্ছ্বাসের কারণ জানার জন্য আমি তাড়াতাড়ি টিভি চালালাম এবং জানতে পারলাম যে নিকটবর্তী জলাধার থেকে জল ছাড়ার কারণে স্থানীয় নদীতে প্লাবন দেখা দিয়েছে এবং যার ফলে এই বিভ্রাট। আমরা কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি যে আমরা যেখানে থাকি সেখানেও মফঃস্বলের মত জলমগ্ন পরিস্থিতি হতে পারে। আর ফলে এখন আমাদের সকলেরই শিরে সংক্রান্তি অবস্থা হয়ে দাঁড়াল। গোটা চেন্নাই শহর নিঃস্পন্দ জলমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিটা রাস্তা জলের তলায়, আর যত সময় যেতে লাগলো ক্রমশ এমন এমন সব বাড়ির ছবি এসে পৌঁছতে লাগলো যেগুলোর সামনে ৫ ফুট থেকে ১০ ফুট জল জমে আছে। অধিকাংশ একতলা বাড়িগুলো সবই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে, আর তাদের গাড়ি বা বাইকগুলো সব জলের তোড়ে ভেসে গেছে। ঈশ্বর কে অশেষ ধন্যবাদ যে আমাদের খুব অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। যদিও এখন আমি নিরাপদ হয়েও বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর কথা ভাবতেও পারছিনা।
বৃহস্পতি বার আমার মোবাইল ডাটা পুনরায় চালু হল আর আমি ফেসবুক ও টুইটার খুলেই দেখলাম শয়ে শয়ে দুর্গতদের আকুতি, বিদেশে বসবাসকারী চিন্তিত ছেলে মেয়েদের পোষ্ট ও এখানকার অবস্থা জানতে চেয়ে আমাকে পাঠানো মেসেজে গোটা সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেছে। তারা জানতে চাইছিল যে তাদের বাবা মায়েরা নিরাপদ আছে কিনা কেননা অন্যান্য অঞ্চলে কোনও প্রকার মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছিল না। এইসব দেখে শুনে আমিও ভেতরে ভেতরে ক্রমে চঞ্চল হয়ে উঠছিলাম এবং আমার রিপোর্টিং জীবনের পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি আমার বন্ধু ও প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করে তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে লাগলাম। অজস্র মেসেজ চালাচালি, ফোন কল ও আত্মীয় পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষদের খুঁজতে ও নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিতে দিতেই সারা দিনটা কেটে গেল। অনেককেই খুঁজে পাওয়া গেল, আর অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না, কেননা তারা ১০ ফুট জলের তলায় ছিল আর রাস্তা বলে প্রায় কিছু ছিলইনা। একটা লম্বা ক্লান্তিকর দিনের শেষে আমি বাড়ি এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম এবং এই চিন্তা করতে করতে ঘুমোতে গেলাম যে সামনে আরও কঠিন দিন আসতে চলেছে...
ঘুম ভেঙে উঠে দেখি দুর্গত মানুষদের পাঠানো হোয়াটস অ্যাপ মেসেজে ভরে গেছে, কোনও অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জন্য ডাক্তার প্রয়োজন, বয়স্ক দম্পতীর জন্য এমার্জেন্সি মেডিক্যাল, সদ্যজাত শিশুর দুধের দরকার, এইরকম বিভিন্ন ধরণের মেসেজ। ফেসবুক ও টুইটারের থেকে বেশ কিছু ভলেন্টিয়ার গ্রুপ তৈরি হয়েছিল যারা এইসব মেসেজ গুলি সমানে প্রচার করছিল এবং সাহায্যকারী দলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল। আমিও আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব করলাম। কিন্তু একটা সময়ের পর আমি বুঝলাম যে বাড়ি তে বসে থেকে এইভাবে মেসেজ আদান প্রদান করে এই বিপুল দুর্যোগের মোকাবিলা করা যায়না, এবং আমি ঠিক করলাম যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে দুর্গত মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের কে আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে। এক বন্ধু কে সঙ্গে নিয়ে আমার গাড়িতে বেড়িয়ে পড়লাম এবং বহু বাড়িতে গেলাম যেখানে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা কারেন্ট এবং পানীয় জলহীন অবস্থায় গৃহবন্দী হয়ে আছেন এবং বাকি দুনিয়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এবং এক হাঁটু জল টপকে বাইরে আসবার কোনও সুযোগ নেই। আমরা তাদের পানীয় জল সরবরাহ করলাম এবং তাদের প্রেসক্রিপসান নিয়ে ওষুধ কিনে এনে দিলাম। তারা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন এবং বলছিলেন যে প্রায় পাঁচ দিন পর কোনও বাইরের মানুষের দেখা পেলেন। তারা সকলেই হাসি মুখে আমাদের সঙ্গে ছবি তুললেন যাতে আমরা সেই ছবি তাঁদের ছেলে মেয়েদেরকে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে পাঠাতে পারি। তাঁরা আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশীদের সন্ধান দিলেন যাঁরা নাকি এর চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই প্রতিবন্ধী অথবা একাকী দম্পতি যাঁদের সর্ব প্রকার সাহায্য দরকার ছিল। আমরা তাঁদের সাহায্য করতে পেরে খুশী হলাম এবং অনেককেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেলাম।
আমি ঠিক করলাম যে আগামী কয়েক দিন এই কাজ করে যাবো এবং মানুষের কাছে পৌঁছনোর আপ্রাণ চেষ্টা করবো ও তাঁদের কে প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে দেবো। আমার পাঠানো সাহায্যের মেসেজ পাওয়া মাত্র আমার বিভিন্ন বন্ধুরা ত্রান সামগ্রী হিসাবে বিতরণের জন্য পানীয় জল, বিস্কুট, দুধের প্যাকেট এবং আরও নানা নিত্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী দান করেছিলেন এবং সেই সমস্ত জিনিষ নিয়ে শুক্র ও শনিবার গোটাটা জুড়ে আমরা নানা দুর্গত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ালাম। আমি সেই সব মানুষদের বন্ধু হিসাবে পেয়ে গর্ব অনুভব করি যারা বলা মাত্র এক কথায় আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন আমাদের দলটাও অনেকটা বড় হয়ে উঠেছে, আমরা চারজন দুটো গাড়িতে করে একটি বৃদ্ধাশ্রমে হাসপাতালে পৌঁছলাম যেখানকার সমস্ত মানুষদের বয়স আশি বছরের বেশী আর আমি যখন তাঁদের সাহায্যের জন্য গেলাম তখন তাঁদের মুখে বলার মত কোনও ভাষা অবশিষ্ট নেই, কেবল দু চোখ দিয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। ফেরবার পথে এক জায়গায় দেখলাম একটা গোটা অঞ্চল বন্যায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং মানুষরা খাবারের সন্ধানে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমার এক অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু দু’শ প্যাকেট খাবার রেঁধে পাঠিয়েছিলেন এবং আমরা তাঁদের মধ্যে সেই খাবার বিতরণ করলাম।
এখন চেন্নাই সমস্ত দিক থেকে সাহায্য পেতে শুরু করেছে এবং সমস্ত অঞ্চলে ভলেন্টিয়াররা সাহায্যের জন্য নেমে পড়েছেন। কিন্তু মানুষ আজ মানবিকতার মূল্য বুঝতে পেরেছে। আমি দেখলাম বদমেজাজি প্রতিবেশী একতলার পরিবার কে আশ্রয় দিচ্ছে, মন্দির মসজিদ গির্জা খুলে দেওয়া হয়েছে সকল প্রকার মানুষের জন্য, অনেককে দেখলাম অচেনা অজানা মানুষের জন্য রান্না করে দিচ্ছেন, বিশাল কমপ্লেক্সে বসবাসকারী মানুষদের দেখলাম বিনা বাক্যব্যয়ে যেকোনো মানুষের থেকে সাহায্য নিচ্ছেন। আর এইসব দেখার কোনও শেষ নেই।
আর শেষে এই কথাই বলার যে, আজ থেকে আবার আমি আমার স্বাভাবিক কাজকর্মে যোগদান করলাম এবং আমি এই সুন্দর কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গর্বিত এবং আনন্দিত যে তাঁরা আমার অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝেছেন এবং অন্যান্যদের মত ওয়েবসাইট আপডেট করার কথা একবারের জন্যও বলেননি। আমাকে বোঝবার জন্য ধন্যবাদ এবং ধন্যবাদ আমাকে আমার চেন্নাই এর জন্য কাজ করবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
(লেখা- ইন্দুজা রঘুনাথন, তামিল ইওর স্টোরির ডেপুটি এডিটর, অনুবাদ- শঙ্খ গাঙ্গুলি)