মাজকারা ডট কম - এক স্বপ্নের উড়ান
যখন দুই প্রতিভাবান মানুষ কাছাকাছি আসেন তখন তাদের কাছে মানুষের তৈরি সীমানা বাধা হয়না। যার জলন্ত উদাহরণ প্রসেনজিৎ দেব গুপ্তা রায় ও মহম্মদ আলির প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। একজন ভারতীয়, অন্যজন পাকিস্তানি। এই দুই যুযুধান দেশের দুই দক্ষ ব্যক্তির বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁদেরই এক বন্ধুর হাত ধরে। ওই বন্ধু দুবাইতে একটি রেস্তোরাঁ খোলার পর রেস্তোরাঁর অনলাইন টেবিল বুকিংয়ের ওয়েব তৈরি করে দেন মহম্মদ আলি। আর প্রসেনজিৎ রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে আরও কার্যকরী রূপ দিতে সাহায্য করেন। এখানেই আলি ও প্রসেনজিতের পরিচয়, বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্ব এক সময়ে জন্ম দিল মাজকারা ডট কম নামে এক গ্ল্যাম টেক ওয়েবসাইটের।
ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভাল অফার কী রয়েছে তারই হালহদিস দিতে শুরু করল এই নতুন ওয়েবসাইট মাজকারা। ক্রেতার বাড়ির সবচেয়ে কাছে তিনি বাজেটের মধ্যে স্পা, স্যালনের সুবিধা কোথায় কোথায় পাবেন তারও হদিস ঘরে বসে পায়ের ওপর পা তুলে পাওয়ার সুবিধা করে দিল মাজকারা।
মাজকারা তৈরির পরিকল্পনাটা প্রথম মাথায় এসেছিল প্রসেনজিতের। পুনের সিম্বায়সিস ইন্টারন্যাশনালের এমবিএ প্রসেনজিৎ জানিয়েছেন, আইডিয়াটা মাথায় আসার পরই তাঁর মনে পড়ে আলির কথা। কারণ আলি এতটাই সুদক্ষ যে তাঁর বিশ্বাস ছিল আলি সহজেই এই সাইটটিকে বাস্তব রূপ দিতে পারবে। আইডিয়াটা ভাল লেগেছিল লাহোরের ছেলে আলিরও। যদিও কর্মসূত্রে আলি শেষ ২৫ বছর দুবাইয়ের বাসিন্দা। স্টাফোর্ডসায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটিংয়ের স্নাতক ও জেন্ড সার্টিফায়েড পিএইচপি ৫ ডেভেলপার আলি ও প্রসেনজিৎ এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে একসঙ্গে মাস দু’য়েক কাজ করেন। কথা বলেন দুবাইয়ের ছোট, বড় সব ধরণের স্পা ও স্যালন মালিকদের সঙ্গে। প্রসেনজিৎ-আলির এই সাইটের কথা তাঁদের প্রায় সকলেরই মনে ধরেছিল। তৈরি হল মাজকারা ডট কম।
প্রসেনজিতের মধ্যে বরাবরই একটা নতুন কিছু করার তাগিদ ছিল। এমবিএয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়া কালীনই তিনি তাঁর প্রথম ভেঞ্চার ‘সেনসাটেক’। রেস্তোরাঁ বা ছোট দোকানের জন্য একটি ডক্সটপ বেসড পিএসও অ্যাপলিকেশনটি অচিরেই নজর কাড়ে অনেকের। পড়াশোনার পাট শেষ হতেই প্রসেনজিৎ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা শুরু করেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে প্রসেনজিৎ তাঁর দ্বিতীয় ভেঞ্চারে হাত দেন। ‘ইন্ডিয়ান জয়েন্ট ফ্যামিলি’ নামে এই প্রকল্পে তিনি পশ্চিমবঙ্গের হস্তশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। কথা বলেন দেশের তাবড় ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গেও। বাংলার গ্রামীণ হস্তশিল্প ও আধুনিক ফ্যাশন ডিজাইনারদের এক ছাদের তলায় এনে চামড়ার আধুনিক জিনিসপত্র তৈরি শুরু করে ‘ইন্ডিয়ান জয়েন্ট ফ্যামিলি’।যা দেশের প্রথমসারির শহরগুলির নামকরা দোকানগুলিতে চুটিয়ে বিক্রি শুরু হয়। এরপরও বেশ কয়েকটি ভেঞ্চারের জন্ম দেন প্রসেনজিৎ। বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ও অপারেশন সংক্রান্ত বিষয়ে দ্রুত উপরের সারিতে উঠে আসে তাঁর নাম। জোমাতো সংস্থার আন্তর্জাতিক দলের সদস্য হন প্রসেনজিৎ দেব গুপ্তা রায়।
জোমাতোর সেলস ম্যানেজার হিসাবে দুবাইতে একটি সীমিত গণ্ডির মধ্যে কাজ করতে করতে কার্যত হাঁপিয়ে ওঠেন প্রসেনজিৎ। নতুন কিছু করার ভাবনা তাঁকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। একদিন আচমকাই তাঁর মনে হয় নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখার জন্য মানুষ চান একটি বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম। যেখান থেকে তিনি জানতে পারবেন শহরের কোথায় কোন স্পা বা স্যালন কী অফার দিচ্ছে, কী করাচ্ছে, তাদের প্যাকেজগুলোই বা কেমন। কিন্তু অবাক কথা যে দেশে ৮৮ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন সেখানে এমন কোনও সাইট নেই যা দেখে মানুষ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মূলত এই পর্যবেক্ষণের হাত ধরেই প্রসেনজিৎ মাজকারা তৈরি করতে ছুটে যান বন্ধু আলির কাছে।
দুবাই শহরের স্যালন স্পায়ের খুঁটিনাটি তথ্য সমৃদ্ধ মাজকারা ডট কম শুরু হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আত্মপ্রকাশের পরেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে মাজকারার খ্যাতি। প্রসেনজিতের দাবি এখন দুবাইয়ে প্রতি মাসে মাজকারার ভিজিটর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন ৫০০-র ওপর অনলাইন বুকিং হয় মাজকারার মাধ্যমে। স্যালন, স্পা মালিকদের জন্য মাজকারাতে বিনামূল্যে নিজেদের অফারের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুবিধাও চালু করেন প্রসেনজিৎ।
দ্রুত সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুবাইয়ের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫ লক্ষ ডলার লগ্নি আসে মাজকারায়। যার সাহায্যে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদদের মাজকারায় নিয়ে আসতে শুরু করেন প্রসেনজিৎ। আস্তে আস্তে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়া চালু হয়। বর্তমানে মাজকারার ৩০ জন ক্লায়েন্ট রয়েছেন। যাঁরা অর্থের বিনিময়ে মাজকারায় নিজেদের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। দুবাইতে ব্যবসা ভালভাবে চালু হওয়ার পর এবার ভারতেও ব্যবসা চালু করেছে মাজকারা। আপাতত পুনে, দিল্লি, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু,মুম্বই ও কলকাতায় কাজ শুরু করেছে তারা।
আলি ও প্রসেনজিৎ যখন দুবাইয়ের কফিশপে বসে মাজকারা তৈরির কাজ করছিলেন তখন তাদের কাছে পথটা মোটেও মসৃণ ছিলনা। প্রায় বিনা মাইনেতে কাজ করতে কোনও প্রযুক্তিবিদই রাজি হচ্ছিলেন না। অবশেষে জোমাতোতে পরিচয় হওয়া অপূর্ব চোপরা নামে এক ইঞ্জিনয়ার রাজি হন। পুনেতে ব্যবসা শুরু করতে গিয়েও সমস্যা পিছু ছাড়েনি। সেখানকার স্যালন ও স্পা মালিকরা বিনা পয়সাতেও মাজকারাতে বিজ্ঞাপন দিতে রাজি হননি। তাঁরা তাঁদের দোকানের যাবতীয় তথ্য সাইটে দিতে ভয় পাচ্ছিলেন। পাশাপাশি প্রসেনজিতের আরও দাবি, নিজেকে সাজিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। ভারতে প্রসাধনী ব্যাবসার বিশাল বাজারও রয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি দিন মাজকারায় ঢুকছেন। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও যে টাকা দুবাইতে তিনমাসে রোজগার করা সম্ভব, ভারতে সেই টাকাই রোজগার করতে ছ’মাস লেগে যাচ্ছে। প্রসেনজিতের আক্ষেপ এজন্য দায়ী ভারতের স্পা মালিকদের মানসিকতা।
আইওএস ও অ্যানড্রয়েডের জন্য মোবাইল অ্যাপ তৈরি করছে মাজকারা। যেখানে থাকবে জিপিএস সুবিধা। যে কাউকে তাঁর বাড়ির কাছের স্যালন বা স্পায়ে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দেবে এই অ্যাপ। সেইসঙ্গে স্যালন ও স্পা মালিকরা যাতে দ্রুত ক্রেতাদের কাছে পৌঁছতে পারেন সেজন্য ক্লাউড বেসড বিজনেস অ্যাপলিকেশনও চালুর করতে চলেছে মাজকারা।
ভারতের বাজারে মাজকারার বর্তমানে মাসিক রোজগার ১০ হাজার ডলার। মাত্র তিন মাসে এই জায়গায় পৌঁছেছে তারা। মাজকারার মাস্টারমাইন্ড প্রসেনজিৎ দেব গুপ্তা রায়ের আসা সব ঠিকঠাক এগোলে ২০১৬-র ডিসেম্বরের মধ্যে মাজকারার মাসিক রোজগার ১ লক্ষ ডলারের গণ্ডি পার করে যাবে।