একাই লড়ে দিন 'বদলাবেন' মুঙ্গেরের জুলি
বিহারের মুঙ্গের জেলার বংশীপুর গ্রামে একজন মাত্র কলেজ পড়ুয়া। নাম তার জুলি কুমারি।
শুনে অবাক হলেন? তাহলে আরো শুনুন।
বংশীপুর গ্রামটি ‘মুশাহার’ সম্প্রদায়ের মানুষদের গ্রাম, অর্থাৎ ইঁদুর পাকরাও করা যাঁদের জীবিকা। আর এই গ্রামের নিকটবর্তী কলেজটি গ্রাম থেকে প্রায় দু ঘন্টার পথ।
যে গল্পটা বলতে চলেছি সেটা পুরোটাই যেন একটা স্বপ্নের মত...
জুলির তখন ক্লাস নাইন। বাড়ি থেকে ঠিক করা হল মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। সেটাই গ্রামের প্রথা। কিন্তু জুলির তখন দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। সে পড়াশোনা করবে, ডাক্তার হবে, পরিবারের ও গ্রামের মানুষের দুঃখ ঘোচাবে। কিন্তু তার সামনে বাধার এক প্রকাণ্ড পাহাড়। আর জুলি জানে যে তাকে তার স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছতে গেলে এই পাহাড় ডিঙিয়েই যেতে হবে। তাকে লড়তে হবে, সে জানে। আর সেই লড়াই যেমন তেমন লড়াই নয়। কঠিন, নজিরবিহীন একক সংগ্রাম। এই লড়াইয়ে সে তার পাশে পাবেনা কাউকেই, কারণ গোটা গ্রামে কেউ কোনদিন এমন কথা শোনেনি যে বাড়ির মেয়ে বিয়ে করে, সংসারের ‘চাক্কি পিসিং’ জীবনে না গিয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চায়!
ইতিমধ্যে, ‘দিশা বিহার’ নামক CRY (Child Rights and You) এর একটি প্রজেক্ট সেই গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে ‘মুন্না মুন্নি মঞ্চ’ নামে এক দল তৈরি করে কাজ করছিল। তারা ঘটনাটির খবর পেয়ে 'দিশা বিহার' এর সদস্যদের জুলির বাড়িতে পাঠায় এবং বহু চাপান উতোরের পর অবশেষে জুলির বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হল।
বিয়ে তো আটকানো গেল, কিন্তু তার পরের ঘটনাক্রমের জন্য জুলি আদৌ প্রস্তুত ছিলনা। তার সমস্ত আত্মীয় স্বজন এবং গোটা গ্রামের মানুষ একত্র হয়ে জুলির বাবা মা কে এই প্রথাবিরুদ্ধ কাজের জন্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুললো। তবে জুলির মায়ের ধৈর্য অসীম। তিনি কোনো প্রশ্নকর্তাকেই ফেরালেন তো না, বরং সকলকে এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন। জুলির মা, যিনি বর্তমানে ASHA এর একজন কর্মী, নিজে বিয়ের আগে দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। বিহারের প্রত্যন্ত প্রদেশের পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের এই মা তাঁর মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য একা লড়ে গেলেন, আর জুলির স্কুলের পড়াশোনা শেষ করা থেকে কলেজে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত একটা শক্ত পিলারের মত মেয়েকে আগলে রাখলেন।
আজ গ্রাম থেকে কলেজের এই দীর্ঘ পথে জুলির প্রতিদিনের সাথী তার দাদা। আর এই দীর্ঘ পথ শুধু তার কলেজের পথ নয়, এই পথের শেষে অপেক্ষা করে আছে তার আজন্ম লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার, তাকে হাত দিয়ে ছোঁয়ার সুযোগ। আর জুলি এই দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছিল বলেই আজ দিদিকে আইডল করে তার দুই বোনও তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। একজন ক্লাস নাইন, অন্যটি ক্লাস সেভেন। দিদির স্বপ্নের কাজল চোখে মেখে তারাও এক নতুন ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় মশগুল।
বিহারে CRY এর অপারেশনাল হেড শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে জানালেন, “জুলি আমাদের কাছে একটা ইন্সিপিরেশান, উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট বা নারী শক্তির জাগরণের এর এক জীবন্ত প্রতিরূপ হল জুলি। যে সাহসিকতা ও মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়ে সে তার বিয়ে আটকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। তার লড়াইটা ছিল একটা আদিম সামাজিক মানসিকতার বিরুদ্ধে, আর এই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে সে তার গ্রামের বাকি মেয়েদের কাছে হয়ে উঠেছে একজন প্রকৃত রোল মডেল”।
জুলি আজ বহু কিছুতেই অদ্বিতীয়া। তার কারণ সে স্বপ্ন দেখবার সাহস দেখাতে পেরেছিল। তার কারণ তার মা নিজের মেয়ের সেই স্বপ্নে বিশ্বাস রাখতে পেরেছিলেন। নারীশক্তি ও মাতৃশক্তির মিলিত প্রয়াসই পারে দিন বদলের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে তুলতে, আরো একবার সে কথাই মনে করিয়ে দেওয়ার।