‘মিস্টার গারবেজ উড’-এর আশ্চর্য দুনিয়া
কাঠের প্রতি ভালবাসা থেকেই লড়াই শুরু। না, কোনও ব্যবসা বুদ্ধি তখন মাথায় খেলছিলনা। শুধু মেনে নিতে পারছিলেন না দামী দামী কাঠের অপব্যবহার, অবহেলা ও নির্মম পরিণতি।
১৯৯৭ সালে কলেজের পড়া শেষ করে টিম ও’ব্রায়েন ইন্দোনেশিয়ার লোম্বোক এলাকায় আপন মনে ঘুরে বেড়াতেন। সেখানকার প্রাকৃতিক সোন্দর্য্য তাঁকে মুগ্ধ করত। ফলে সেখানেই কিছুদিন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় তাঁর নজরে পড়ে এখানকার মানুষ দামী দামী কাঠের তৈরি মাস্তুল অনায়াসে ফেলে দিচ্ছে। অনেক বাড়ি থেকে কাঠ ফেলে সেখানে কংক্রিট করা হচ্ছে। আবলুস বা সেগুন কাঠ রোদে জলে জঞ্জালের মত পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। অথবা স্থানীয় লোকজনের বাড়ির উনুনের আঁচ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে।
এটা মেনে নিতে পারেন নি তিনি। দ্রুত একটি গুদাম ভাড়া করেন ব্রায়েন। আর স্থানীয়দের কাছ থেকে আপাত অবহেলিত কাঠ জলের দরে কিনে নিতে শুরু করেন। এভাবে কাঠ জমাতে জমাতে একসময়ে টিমের মাথায় আসে একটা ব্যবসা বুদ্ধি। দ্রুত স্থানীয় কিছু ছুতোর মিস্ত্রিকে জড়ো করে তাঁদের সাহায্যে কাঠের আসবাব তৈরি শুরু করেন তিনি। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরল। একাধারে কাঠও বাঁচল, আবার ব্যবসারও পথ খোলা হল। কিন্তু এ উদ্যোগ বেশিদিন ধোপে টেকেনি। অল্প দিনের মধ্যেই বেঁকে বসলেন ছুতোররা। ফেলে দেওয়া কাঠ দিয়ে আসবাব বানানোর কাজে তাঁরা অসম্মান বোধ করতে লাগলেন। তাঁদের কাছে এসব কাঠ নেহাতই জঞ্জাল। কাজ ছাড়লেন তাঁরা। আর মজা করে টিমের নাম দিলেন ‘মিস্টার গারবেজ উড’।
অল্প দিনের মধ্যেই স্থানীয় লোকজনের হাসির খোরাক হয়ে গেলেন টিম। ফলে তাঁর ব্যবসাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। কিন্তু ওসব কাঠের মূল্য সকলের কাছে তুলে ধরার লড়াইয়ে ইতি টানলেন না তিনি। বরং জাহাজের ফেলে দেওয়া কাঠ কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ডিজাইনের আসবাব ও অন্যান্য কাঠের জিনিস তৈরিতে নিজের সৃজনশীলতার ছাপ রাখতে শুরু করলেন ব্রায়েন। কাজ করতে গিয়ে ব্রায়েন লক্ষ করলেন আম বা দুরিয়ানের মত কাঠ অন্য কাঠের সঙ্গে মেশালে কাঠে পোকার প্রকোপ বাড়ছে। যা পালিশ করার পরও থাকছে। তাহলে কি করা যায়? ও’ব্রায়েন এবং তাঁর টিম নিজেরাই একটি কীটনাশক তৈরি করলেন। যার ব্যবহারে কোনও ঝুঁকি থাকে না। আবার বেশ ভালো কাজ দেয়।
এদিকে এতদিন কাজের সুবাদে টিমের কাছে এই উন্নত মানের কাঠের জিনিসের ব্যবসার ঘাঁতঘোঁত পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? আরও উন্নতমানের কাঠ খুঁজতে শুরু করলেন টিম। এই খোঁজে নেমে টিমের একটা বিষয় নজর কাড়ল। এই অঞ্চলে প্রচুর আগ্নয়গিরি থাকায় সেখানে বিভিন্ন সময়ে আগ্নুৎপাত হয়েছে। আবার এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সংখ্যাও বড় একটা কম নয়। এই দুই প্রাকৃতিক দুর্যোগ অসংখ্য গাছ উপড়ে দিয়েছিল। তার অনেক গাছই জলে ভেসে এসে নদীগহ্বরে জমা হয়েছে। ফলে নদীর তলদেশে প্রচুর কাঠের গুঁড়ির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। টিম আরও অবাক হলেন এখানকার বেশ কিছু ধান জমিতে মাঝেমধ্যেই উঠে থাকা বড় বড় গাছের গুঁড়ি দেখে। ধান খেতে এমন কাঠের গুঁড়ি কোথা থেকে এল তা জানতে গবেষণা শুরু করেন তিনি। টিম জানতে পারেন বহু বছর আগে এখানে অগ্নুৎপাতের সময় বহু গাছ মাটির তলায় চলে গিয়েছিল। পরে মাটির ক্ষয় ও ভূমিকম্পের জেরে সেসব সমাহিত গাছেরই কয়েকটি মাটির ওপর উঠে এসেছে। আর অধিকাংশ জলা জঙ্গলের তলায় চলে গেছে। ঘন ঝোপে ঢাকা জলাজমির তলায় চলে যাওয়ায় সেসব গাছ হাজার হাজার বছর অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পারেনি। যা সেগুলিকে আরও শক্তপোক্ত করেছে। আর জলের তলায় বিভিন্ন ধরণের খনিজ সেগুলিকে আরও সুন্দর হয়ে ওঠায় সাহায্য করেছে। টিমের কাছে জলার তলায় লুকিয়ে থাকা গাছের সন্ধান যেন সোনা পাওয়ার সামিল হল।
দশ বছরে টিমের কাঠের জিনিসের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে তাঁর গ্রাহক সংখ্যা নেহাত কম নয়। খোদ ইন্দোনেশিয়াতে তাঁর ৮০ জন কর্মী রয়েছেন। তবে যতই কাঠের ব্যবসায় মন দিন না কেন, এখনও তাঁর প্রাথমিক অঙ্গীকার থেকে এতটুকুও সরে আসেননি ব্রায়েন। এখনও জঙ্গল সংরক্ষণের কাজ তিনি পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যপারে জেপারা ফরেষ্ট কনজারভেনসি প্রকল্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করছেন ব্রায়েন। সেইসঙ্গে বৃক্ষ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপন নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে চলছে আঞ্চলিক জঙ্গলগুলিতেও বৃক্ষরোপনের কাজ। ৩৫ ধরণের প্রজাতির ৫০০-র ওপর গাছ ইতিমধ্যেই রোপন করেছেন ব্রায়েন। আর বেশি করে মানুষের মধ্যে জঙ্গল বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে সম্প্রতি ডাবলু ডাবলু এফ সুইৎজারল্যান্ড ট্রপিক্যাল ফরেষ্ট চ্যালেঞ্জেও শরিক হয়েছেন টিম ও’ব্রায়েন। বিশ্বের ৭৫টি বাছাই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলে আরও বেশি করে কিভাবে গাছ বাঁচানো যায় তা খুঁজে বার করাই এই চ্যালেঞ্জের লক্ষ্য। সেইসঙ্গে স্থানীয় লোকজনকে কাঠের জগতে জীবন কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে ব্যবসার সূত্র খুঁজে বার করারও পাঠ দিচ্ছেন টিম। এ কাজে তাঁর উৎসাহের অন্ত নেই। কারণ গাছ বাঁচানো এবং তার সুফলকে ব্যবসার কাজে লাগানোকে একসূত্রে বাঁধার মধ্যে আজও এক অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেন ‘মিস্টার গারবেজ উড’।