ছোটো থেকে অঙ্কে মাথা। ভেবেছিলেন ইঞ্জিনিয়র হবেন। কিন্তু পড়েছেন বাংলা অনার্স। তারপর এমবিএ। সঞ্জয় হয়ে গেলেন সাংবাদিক। তারপর সাংবাদিকতায় ইতি টেনে এখন ও পুরোদস্তুর উদ্যোগপতি। শুনে মনে হচ্ছে হয়তো, এখান থেকে মারলাম তীর/ লাগলো কলাগাছে/ হাটু বেয়ে রক্ত পড়ে/ চোখ গেল রে বাবা।
বীরভূমের সিউড়ির বত্রিশ বছরের যুবক সঞ্জয় চক্রবর্তীর জীবনে এরকমই ঘটেছে। হার্ডকোর সাংবাদিক থেকে অদম্য জেদ ও নতুন কিছু করার ভাবনাকে সম্বল করে আজ সে আরও বেশ কয়েকজন বিপদে পড়া সাংবাদিক সহকর্মীর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। গড়ে ফেলেছেন একটা কোম্পানি। তার মারফতই কাজ। কিন্তু তার মালিকানা দিয়েছেন সেই কোম্পানির কর্মীদেরই। সংস্থা চালনার এই ইউনিক টেকনিক কাজের ক্ষেত্রে সঞ্জয়ের অনেক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে।
ইটিভিতে কাজ করেছেন এগারো বছর। বীরভূম জেলার দায়িত্বে ছিলেন। ততদিনে ঘর সংসারও ডালপালা মেলেছে। বেশি বেতনের তাগিদে যোগ দেন চ্যানেল টেনে। সেখানেই খেলেন ধাক্কা। সঞ্জয় বললেন, “সারদা কেলেঙ্কারি অনেক সাংবাদিকের মতো তাকেও পথে বসিয়েছিল। কিন্তু বিলাপ না করে নিজে বাঁচার, বন্ধুদের বাঁচার রসদ তৈরির পরিকল্পনা করা শুরু করি। ভাবতে থাকি নিজের প্লাস পয়েন্ট, মাইনাস পয়েন্ট।” পরিশ্রমটা ছিল জিনে। আর একটা জিনিস আছে তার। সততা।
সেই মূলধন নিয়ে হঠাৎ একদিন ফেসবুকে লিখে ফেললেন কয়েকটা লাইন। ‘আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুদের সাহায্য চাই। কাউকে চাকরি ছাড়তে হবে না, আমার লড়াইয়ে সামিল হোন। প্রথাগত চাকরির বাইরে একটা কিছু করব।‘ এই ঘোষণার এক বছরের মাথায় তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেলেন খোদ ভারত সরকারের কাছ থেকেই। আবার ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট। কৃতিত্ব দিলেন সবাইকে। নিজেকে বললেন অর্গানাইজার। জেলায় সাংবাদিকতা করার সুযোগ, আর ভালো সম্পর্ক রাখা। এটাই সঞ্জয়ের ইউএসপি। তাঁর হাতে গড়া সৌভার্য্য কমিউনিকেশন এখন শুধু ব্যবসায়িক কাজ করে না, এককালের তার সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুদেরও ঘরে বসে কমবেশি আয়ের ব্যবস্থা করেছে। সাংবাদিকতার মাঝে এমবিএ পড়াটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন এই উদ্যোগী বাঙালি। কাছে থাকা ক্যামেরাটায় জং ধরতে না দিয়ে একদিন এলাকার এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর মেয়ের বিয়ে শ্যুট করার দায়িত্ব নিলেন। এবং দিলেন নতুন আইডিয়া। মেয়েক নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়ে দেবেন, বিয়ের আসরে দেখানোর জন্য। নতুন আইডিয়া ক্লিক করে গেল। সঞ্জয় হয়ে গেলেন অগার্নাইজার। ক্যামেরা তো ছিলই, প্রাথমিক অবস্থায় সাত হাজার টাকা নিয়ে কাজ শুরু করেন। স্থানীয় কেবল চ্যানেলের স্টিল ও ভিডিও ফটোগ্রাফারকে নিয়ে শ্যুট। কলকাতায় ভালো স্ক্রিপ্টিং। সঙ্গে নিলেন ভালো ভিডিও এডিটরকেও। সবাই পুরনো সহকর্মী। ডিভিডি রেডি। সবাই পেল পারিশ্রমিক।
সঞ্জয় বললেন, একা বাঁচা যায় না। যিনি যে কাজে পারদর্শী, তাঁকে সম্মান দিয়ে কাজ করাতে পারলে ভাবনা থাকে না। কাজের কোয়ালিটির সঙ্গে কোনও সমঝোতা নয়। সঞ্জয়ের এই তথ্যচিত্রের আইডিয়া তাঁকে আরও স্বপ্ন দেখাল। ছেলের নামে গড়ে তুললেন কোম্পানিটা। সৌভার্য কমিউনিকেশন। ধীরে ধীরে বাড়াতে লাগলেন কাজের পরিধি। যুক্ত করতে থাকলেন একের পর এক তাঁর পুরনো সাংবাদিক সহকর্মীকে। তিনি বলেন,’’আমাদের এই সংস্থা বর্তমানে প্রায় পঁয়ত্রিশ চল্লিশ জনের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। এক একটি প্রজেক্টে আমরা যে টাকা রোজগার করি, তার একটি অংশ কোম্পানির অ্যাকাউন্টে রেখে, বাকিটা সবাই মিলে ভাগ করে নিই। এই কোম্পানি সবার, কারোর একার নয়।”
এখন আর শুধু ডকুমেন্টারি বা ভিডিও শ্যুট নয়, প্রিন্টিং, ডিজাইনিং, লোগো মেকিং, অনলাইন এডিটিং সব ধরণের কাজেই সৌভার্য্য কমিউনিকেশন বীরভূমে নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করেছে। এই সংস্থার তৈরি লোগো মিশন নির্মল বীরভূম ভারত সরকারের স্বচ্ছ ভারত প্রোফাইলের ওয়েবসাইটে একনম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। আবার এই সংস্থাই জেলার জন্য যে নির্বাচনী লোগো তৈরি করেছিল, তা জাতীয় নির্বাচন কমিশন স্বীকৃতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্জয় বললেন, ”চ্যানেল টেনের সেই অন্ধকার সময়টা আমার জীবনে অন্য আলো এনে দিয়েছে। শুধু এখানে ওখানে চাকরি খোঁজার চক্র থেকে বেরিয়ে এসে, নতুন কিছু করার তাগিদ পেয়েছি।” বিভিন্ন সংস্থার কাজ করার পাশাপাশি, রাজনৈতিক দল, সরকারি কাজে সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন সংস্থার কর্মীরা। বাড়তে বাড়তে এখন বছরে প্রায় তিরিশ লক্ষ টাকার কাজ করে সঞ্জয়ের এই সংস্থা। জেলায় বসে সঞ্জয়ের এই তাগিদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার কয়েকজন সহকর্মীও নতুন করে ভাবনা ভাবার সাহস পাচ্ছে। সঞ্জয় এবং সৌভার্য্য কমিউনিকেশনের সাফল্য সেখানেই।