আসন্ন মৃত্যুর মুখ থেকে স্বর্গের টিকিট লাভ
সম্প্রতি আমাদের এক পোর্টফোলিও কোম্পানির বোর্ড মিটিঙে এমন একটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হচ্ছিল যা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিনিয়োগকারীদের খুব বেশী বেশী করে ভাবাচ্ছে, আর তা হল এই যে, কিভাবে বাজার থেকে টাকা তোলা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
অর্থাৎ অন্য ভাবে বললে, হিমযুগ আসছে।
শুনতে খুব বিমর্ষ ও নিরাশাজনক লাগছে তাইনা? বিশেষত একদিকে যখন এই ২০১৫ সালেই ইতিমধ্যে ভারতীয় শুরুয়াতি সংস্থা গুলির লক্ষ্মীর ঝাঁপি রীতিমত ভর ভরন্ত, তখন সেই বাজারে এই অভিমতকে মাথায় রাখা দরকার যে শ্রেষ্ঠ কোম্পানি গুলো কিন্তু সবচেয়ে কঠিন সময়তেই গড়ে ওঠে। আর এই অভিমত যথেষ্ট জোরালো যে GE থেকে Apple পর্যন্ত অধিকাংশ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি গুলি অর্থনৈতিক মন্দার সময়তেই তৈরি হয়েছে।
এই প্রতিবেদনের একটি প্রধান অনুপ্রেরণা অবশ্যই Apple যা প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মুখ থেকে ফিরে এসে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা মূল্যবান কোম্পানি তে পরিণত হয়। তারচেয়েও বড় কথা এটি অসাধারণ সফল কোম্পানি তৈরির ব্যাপারে স্টিভ জোবস এর অমর ঐতিহ্য কে মনে করিয়ে দেয় এবং তাঁর ক্যান্সারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের স্মৃতিকেও উস্কে দেয়। যাইহোক অ্যাপেল এবং স্টিভ জোবস কে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত ও সন্তন্ত্র একটি পোষ্ট (বা এক ডজন পোষ্ট) প্রয়োজন আছে। কিন্তু কথা হল আপনার শুরুয়াতি ব্যবসাকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেন কিভাবে আর কিভাবেই বা সেই অভিজ্ঞতা কে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের লক্ষ্মী লাভ করবেন?
ইউটিউবের সীড ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে Sequoia এর দেওয়া একটি মেমো তে আকর্ষণীয় কিছু উপলব্ধির কথা উঠে এসেছিল। বিশেষত ইউটিউবের প্রতিষ্ঠাতাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে রোলোফ বোথা শুরুতেই কোন বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন সেটি লক্ষ্য করুন।
তিনি ওঁদের বলেছেন ‘স্ক্র্যাপি’।
আর স্ক্র্যাপি বলতে ঠিক কি বোঝায়? গুগল সার্চ করলে যে ফলাফল আসে তা হল এইরকম–
অনেকেই হয়ত ভাবছেন যে রোলোফ যখন মেমোটি তৈরি করেছিলেন তখন নির্ঘাত স্ক্র্যাপি শব্দটির চলতি অর্থটিই তাঁর মাথায় ছিল। কিন্তু আপনাদের মধ্যে যাঁদের অল্প বিস্তর কল্পনা শক্তি রয়েছে আর যাঁরা ‘জুগ্গার’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত, তারা স্ক্র্যাপি বলতে এও ভাবতে পারেন যে তিনি হয়ত এমন কারুর কথা বলতে চেয়েছেন যিনি পেটের ভাত যোগাড়ের জন্য লোকের কাছে হাত পাততে প্রস্তুত এবং যিনি অত্যন্ত হিসাবী ও মিতব্যয়ী।
তাছাড়া ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগকারীরা স্ক্র্যাপি শব্দটি অধিকাংশ সময় প্রশংসাসূচক শব্দ হিসাবেই ব্যবহার করে থাকেন, আর বলা বাহুল্য, ইউটিউব প্রতিষ্ঠাতাদের সম্পর্কে রোলোফ এর এই মূল্যায়নটিও নিঃসন্দেহে তারই প্রতিফলন।
একদিকে যেমন স্ক্র্যাপি শব্দটির সঙ্গে ‘দৃঢ় সংকল্প’ এর একটি সুস্পষ্ট মিল রয়েছে, অন্যদিকে আমার মতে স্ক্র্যাপিনেস হল কার্যকারিতা ও দক্ষতার প্রতি সহজাত একাগ্রতা যা মুনাফালাভে সহায়তা করে। কঠিন লড়াই এর বাজারে বিনিয়োগকারীরা উচ্চ বার্ন রেট এর ব্যাপারে সতর্ক থাকেন, অথবা তাঁরা এমন ব্যবসায় বিনিয়োগে আগ্রহী হন যা হয় ইতিমধ্যে লাভের মুখ দেখেছে অথবা যার মুনাফা লাভের সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি আছে।
নীচের চারটি উদাহরণ থেকে আমরা অতি সহজেই বুঝে নেব যে কেন স্ক্র্যাপি পথই হল মৃত্যু পথযাত্রী শুরুয়াতি ব্যবসার অক্সিজেন লাভের একমাত্র নিশ্চিত উপায়।
১) অ্যামাজন
ডট কম ক্র্যাশ এর মৃত্যুর মিছিল থেকে অ্যামাজন কিভাবে বেঁচে ফিরল তা নিয়ে কুয়োরা অ্যানসারে ঋষি গোরান্তালা এই অসাধারণ বিশ্লেষণত্মক উত্তর টি দিয়েছেন। ঋষি দেখিয়েছেন কিভাবে অ্যামাজন এর OCF (Operating Cash Flows) ও নেট ইনকাম ট্রেন্ড এই কোম্পানিটি কে ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা ও নিজেকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি মুনাফা লাভের পথেও এগিয়ে নিয়ে যায়। যদিও, তাঁদের IPO এর সময়জ্ঞান নিয়ে আমি মোটেই একমত নই। বিশেষত যেখানে Pets.com-ও তিনশ মিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়গকৃত মূলধন ধ্বংস করে বাজারে নেমেছিল যাকে ডট কম বুদবুদের বৃহত্তম বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে। মজার কথা হল অ্যামাজন তাদের প্রথম রাউন্ডের ভেঞ্চার ফান্ডিং বিনিয়োগ করেছে Pets.com এই।
২) বুক মাই শো
বুক মাই শো ভারতীয় ইন্টারনেট সংস্থাগুলির মধ্যে এমন একটি অভিজাত গোষ্ঠীর অংশ (যে গোষ্ঠীতে জাস্ট ডায়াল ও মেক মাই ট্রীপ এর মত সংস্থাগুলিও রয়েছে) যারা ২০০১ সালের ডট কম ক্র্যাশের ধাক্কা সামলে আজ হয়ে উঠেছে গেরস্থালীর চেনা নাম। যদিও বুকমাইশো এর প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার আশিস মেহরাজানির মতে তাঁদের এই যাত্রাপথটি গোলাপ বিছানো তো ছিলোইনা, বরং একাধিক বার গঙ্গাযাত্রার পথ থেকে ফিরে আসবার মত অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেইসব অভিশপ্ত দিনগুলির স্মৃতি এখনো তাঁর মনে রীতিমত টাটকা- কর্মচারী সংখ্যা ১৫০ থেকে কমিয়ে আনতে হয়েছিল মাত্র ৬ জনে, বিদ্যুৎ ও ষ্টেশনারী খরচের মত বিষয়েও নিয়মিত পুঙ্খানুপুঙ্খ খবরদারী করতে হত। আর এতেই শেষ নয়, এমনকি গাড়িতে তেল ভরার আগেও তাঁকে দু’বার ভাবতে হত- আর এ সবই করতে হত ক্লায়েন্টদের মুখ চেয়ে যাতে তাঁদের ঠিকঠাক পরিষেবা দেওয়া যায় এবং কোম্পানির ক্যাশ ফ্লো কে ইতিবাচক অবস্থায় রেখে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া যায়।
৩) ক্র্যাফটসভিলা
ক্র্যাফটসভিলার সাম্প্রতিক ১১০ কোটি টাকার সিরিজ বি-রাউন্ডের আগে এই সংস্থা কে রীতিমত অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আর এই অগ্নি পরীক্ষার মধ্যে অনেক কিছুর সঙ্গে ছিল “দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ও তার প্রস্তুতিও।”
তবে ক্র্যাফটসভিলের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার মনোজের লেখায় তাঁর সাংগঠনিক ছকের মধ্যে এই স্ক্র্যাপিনেসের সারমর্ম টি খুব অল্প কথায় ধরা পড়েছে, আমরা লাভজনক হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম যাতে আমাদের ভিসি (ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট)-দের মর্জি ও আর্থিক আনুকূল্যের অধীন না থাকতে হয়, আমরা লাভজনক হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম যাতে ভিসিরা আমাদের পেছনে দৌড়য়, আমাদের ভিসির পেছনে দৌড়তে না হয়, যার থেকে খারাপ কিছু হতে পারেনা।
৪) হোয়াটস অ্যাপ
জনপ্রিয় মতামতের মতে, ফেসবুকের দ্বারা হোয়াটস অ্যাপ কে কিনে নেওয়ার ঘটনা টি হল সর্বকালের সেরা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ডিল গুলির মধ্যে অন্যতম, চূড়ান্ত মূল্য মানের দিক থেকেও আর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মাল্টিপল অফ রিটার্ন এর ক্ষেত্রেও এটি হল এক যুগান্তকারী ঘটনা।
হোয়াটস অ্যাপ কিভাবে গড়ে উঠেছিল সেই ইতিহাস থেকে প্রচুর শিক্ষা নেওয়ার আছে। এর গল্পটা আগের গুলির মত সংস্থার উন্নতির পথে বাধা অতিক্রমের গল্প নয়। হোয়াটস অ্যাপ এর জন্মের মধ্যে আছে তীব্র প্রতিযোগিতা ও বিদ্বেষী মনোভাব (ব্রায়ান আক্টন ফেসবুক ও টুইটারে চাকরীর দরখাস্ত করে প্রত্যাখ্যাত হন)। মার্কেটিং এর পিছনে এক টাকাও খরচা না করে এবং মাত্র ৫৫ জনের শক্তিশালী টিম নিয়ে (ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ফান্ডিং থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার তুলতে সক্ষম হয়ে) বিশ্বব্যাপী টেক্সট মেসেজিং কে এক অন্য মাত্রা দেওয়ায় স্ক্র্যাপি অন্ত্রেপ্রেনিওরদের মধ্যে এঁরা এখন অত্যন্ত সম্ভ্রমের স্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
আপনিও কি আপনার মৃত্যু পথযাত্রী শুরুয়াতি ব্যবসাটি নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন আর ভাবছেন আর কোন কোন দিক থেকে বাধা আসতে পারে? তাহলে চিন্তার কিছু নেই, বরং এক মুহূর্ত মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখুন যে দুনিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উদ্যোগপতিদের সঙ্গে আপনার কতো মিল। আর কি ভাবে আপনি সেই চ্যালেঞ্জ কে গ্রহণ করতে পারবেন তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে যম কে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা আর আপনার কোম্পানির নতুন জীবন লাভের চাবিকাঠি।