বাংলার স্বদর্প পদচারণার প্রতীক, শ্রীলেদার্স
বাংলার পাদুকাশিল্পের কথা উঠলেই প্রথমেই যে সংস্থাগুলির নাম মাথায় আসবে, শ্রীলেদার্স তার মধ্যে অন্যতম। জামশেদপুর থেকে শুরু হওয়া এই সংস্থা সময়ের সাথে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের বিভিন্ন শহরে।বর্তমানে কলকাতার লিন্ডসে স্ট্রিটে অবস্থিত শ্রীলেদার্স এর বিপনণি হল বিশ্বের বৃহত্তম একক ব্র্যান্ডের ‘ফুটওয়্যার’ এর শোরুম। তবে শুধু দেশীয় চৌহদ্দী নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিবিধ দেশের ক্রেতামহলেও শ্রীলেদার্স বর্তমানে রীতিমত সুপরিচিত একটি নাম।
একভাবে দেখতে গেলে, ১৯৫২ সালে হওয়া প্রতিষ্ঠা হওয়া এই সংস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক পরিকল্পনার মূলে ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী সুরেশ্চন্দ্র দে’র জাতীয়তাবাদী চেতনা, যিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাঁর বয়েস তখন মাত্র উনিশ। কৈশোর থেকেই তিনি ছিলেন কুস্তি, অশ্বারোহণ সহ বিবিধ ধরনের শারীরিক কসরত এবং খেলাধূলায় পারদর্শী। ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আদর্শ তাঁকে নিয়ে আসে সশস্ত্র সংগ্রামের ময়দানে। ১৯৩০ এ চটগ্রাম শহরে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে পঁয়ষট্টি জনের যে সশস্ত্র বাহিনী ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুঠ করে, এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ আক্রমণের মুখে জালালাবাদ পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে বীরত্বপূর্ন প্রতিরোধ চালায়, সুরেশচন্দ্র দে ছিলেন সেই সশস্ত্র বাহিনীর অন্ত্যতম সদস্য। ১৯৩৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে।
অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য যে দেশীয় পুঁজির বিকাশ লাভ করা প্রয়োজন, দূরদর্শী এই মানুষটি তা উপলব্ধি করেছিলেন। এবং সেই ভাবনা থেকেই ১৯৫২ সালে জামশেদপুরে শ্রীলেদার্স সংস্থার গড়ে ওঠা। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তখন মাত্র পাঁচ বছর অতীত হয়েছে। সদ্যস্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের তখন শৈশব অবস্থা। জর্জর একাধিক সংকটে। এরকম এক সময়ে সাধারণ মানুষ জুতো বা চপ্পল ব্যবহারের কথা বিশেষ ভাবতে পারতেন না। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছেই জুতো ছিল বিলাসিতার জিনিস। আর এরকম একটা জিনিসকেই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় সুরেশ্চন্দ্র দে’র উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই সংস্থা। সস্তায় আমজনতার কাছে টেকসই জুতো পৌঁছে দিতে সক্ষম হন তিনি। সংস্থার এগিয়ে চলার চলার মূলমত্র ছিল একটাই – বিশ্বমান ও কম দাম। ফলে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই সংস্থা। বৃদ্ধি পায় চাহিদা। দেশের একাধিক শহরে তৈরি হয় শোরুম। এবং অনতিবিলম্বেই দেশের পরিধি ছাড়িয়ে শ্রীলেদার্স পা রাখে বিদেশের বাজারেও।
দূরদর্শী, প্রতিস্পর্ধী এই উদ্যোগপতি শ্রী সুরেশচন্দ্র দে’র জীবনাবসান হয় ১৯৯১ সালে। তাঁর প্রয়াত হবার পর থেকে বিপুল এই সংস্থার কার্যভার সামলেছেন ওনার দুই পুত্র সত্যব্রত দে এবং শেখর দে। বর্তমানে পারিবারিক ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেছেন এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের সদস্যরাও।