স্টার্ট আপ শুরু করার আদর্শ সময় কোনটা?
কয়েকসপ্তাহ আগে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, ত্রিচিতে ব্যবসায়িক উদ্যোগ সম্বন্ধে একটি বক্তব্য রেখেছিলাম। ছাত্রছাত্রীদের সাথে একান্তে আলাপেরও সুযোগ হয়েছিল সেখানে। এবং পাশাপাশি NIT, ত্রিচি – যা একই ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত, কথা বলার সুযোগ হয়েছিল সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের সাথেও।
অনেকেই আমাকে বলছিলেন যে “আমার কাছে একটা ভালো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে আমার কি এখনই স্টার্ট আপ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত? নাকি কিছুদিন অপেক্ষা করে, কিছু কাজের অভিজ্ঞতা তৈরি করে নিয়ে তারপর শুরু করাটা শ্রেয় হবে?”
যদি তর্কের খাতিরে আপাতত ধরে নেওয়া হয় যে তাদের পরিকল্পনাগুলি প্রকৃত অর্থেই ভালো, সেক্ষেত্রে তাদের প্রশ্নের জবাব কি হবে? তরুণ ছাত্রছাত্রীদের বাস্তবিকই দুনিয়াদারিই সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তাদের কাছে এ প্রশ্নের জবাব জানাটা যেমন প্রয়োজন, তেমনই এর উত্তর দেওয়াটাও সেই একই কারণে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার।
কিন্তু এই অনুসন্ধিৎসার আগেও থাকে আরো মৌলিক এক প্রশ্ন – সেটা এই যে, স্টার্ট আপ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা কি?
স্টার্ট আপ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা কি?
স্টার্ট আপ নিয়ে এ মুহুর্তে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনার আবহ রয়েছে, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদি আপনি শুধুমাত্র এটা জেনে থাকেন যে ফ্লিপকার্ট কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা করছে অথব স্ন্যাপডিল ফ্রিচার্জ কিনছে, তাহলে কিন্তু বলব যে আপনি ব্যবসায়িক বাস্তবতার কেবলমাত্র ইতিবাচক দিকটাই দেখছেন। কিন্তু ঘটনা হল, ৯২ শতাংশ স্টার্ট আপই ব্যর্থ হয়। এবং যারা টিকে থাকতে পারে, তাদের সবার ক্ষেত্রেই যে সাফল্যের হার উল্লেখজনক, এমনটাও কিন্তু নয়। ফলে , প্রচুর লাভ হবে – আগে থেকেই এই জাতীয় আশা করে ব্যবসা শুরু করবেন না। এমনকি, খানিকটা হলেও লাভ থাকবে – এরকম আগাম নিশ্চিন্তির ভাব থেকেও এগোনোটা উচিত নয়।
নিজের ব্যবসা গড়ে তোলাটা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। এমনকি সফল সংস্থা উবের এর এলন মাস্কের মতে, ব্যবসা গড়ে তোলাটা অনেকটা ধূমপানের সাথে তুলনীয়। লাভের প্রত্যাশা যদি খুব কম হওঁয়, তাহলে নিজের ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য শ্রম দেওয়ার কোনো অর্থই হয়না। বিশেষ করে যেখানে স্থায়ী চাকরিতে উপার্জনের সুযোগ অনেকটাই বেশি।
কিন্তু চড়া হারে লাভের সম্ভাবনাই যদি না থাকে, তাহলে স্টার্ট আপ গড়ে তোলার দরকারটাই বা কি? বিগত দু'বছর ধরে নিজের ব্যবসা সাফল্যের সাথে গড়ে তোলার যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তার নিরীখে আমি এ প্রশ্নে নিজের মতামত জানাচ্ছি।
১)শূন্য থেকে শুরু করে একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর অভিজ্ঞতা আপনাকে ধৈর্যশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন করে তুলবে। খুব কম জিনিসই এর সাথে তুলনীয়। বারবার ‘না’ শুনেও ধৈর্য্য ও ইচ্ছা হারালে চলবেনা।অবশ্য বহুবার না শুনে শুনে অনেক পরিশ্রমের পর যখন অবশেষে ইতিবাচক কোনো উত্তর পাবেন, তার আনন্দই হবে আলাদা।
২)নিজের উদ্যোগে কিছু তৈরি করার একটা অন্যরকম আনন্দ রয়েছে। প্রথমবার ‘হ্যালো ওয়ার্ল্ড’ প্রোগ্রাম লিখে যতটা খুশি হয়েছিলেন, এটা হবে তার ত্থেকেও অনেক বেশি।
৩) অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবেন। স্টার্ট আপ গড়ে তুলতে হলে যা কিছু অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, জানার প্রয়োজন, তা একমাত্র গড়ে উঠতে পারে...স্টার্ট আপের উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যে দিয়েই (এ প্রসঙ্গে আমি খানিক পরে আবার ফিরব)।
৪)এবং আপনার উদ্যোগ সফল হবে, আপনি লাভের মুখ দেখবেন ও এরকম দিন আসবে যখন অর্থোপার্জনের জন্য আপনার আর অন্য কিছু করার প্রয়োজন পড়বেনা - এরকমটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এতোটাই ক্ষীণ যে, অনেক ক্ষেত্রেই গড় উপার্জন ‘ফুল টাইম’ চাকরির থেকে কমই হবে(এবং ‘ফুল টাইম’ চাকরির ক্ষেত্রে চাপটাও অনেকটাই কম থাকে)।
তাই উপার্জনের সম্ভাবনা কম থাকলেও, একটা নতুন কম্পানী গড়ে তোলার উদ্যোগের নিশ্চিতভাবেই কিছু গুরুত্ব আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, স্টার্ট আপ শুরু করার জন্য এটাই কি আপনার পক্ষে উপযুক্ত সময়? নাকি, কলেজ ক্যাম্পাসে বা স্থায়ী চাকরিতে যেমনটা মনে করা হয়ে থাকে, সে্রকম মতামত গ্রহণ করে নিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে তারপর শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত?
অপেক্ষা করা উচিত কি?
স্টার্ট আপ শুরু করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে বেশিরভাগ সময় যে উত্তর পাওয়া যায়, তা হল –
১)“আগে কিছু কাজের অভিজ্ঞতা হোক। নভিশের মত ভুল করতে চাইনা।”
২)“আগে মোটামুটি একটা মূলধন যোগাড় হোক।”
৩)“আগে একটা যথাযথ পরিকল্পনা দরকার। রোজই আমার মাথায় তিন-চার রকম পরিকল্পনা আসে, কিন্তু তারপর সেগুলো নিয়ে একটু গবেষণা করতে গিয়েই দেখি যে হয় আগেই কেউ সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে, অথবা সেই ধরনের উদ্যোগগুলি ব্যর্থ হয়েছে।”
মতামত হিসাবে সমস্তকটাই ভালো। কিন্তু সঠিক নয়। কারণ –
১)অভিজ্ঞতা – বলতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, একটা ব্যবসা কিভাবে গড়ে তুলতে হয়,সেটা কিন্তু কোনো অভিজ্ঞতাই আপনাকে শেখাতে পারবেনা। শেখার একমাত্র রাস্তা হল হাতে কলমে করে দেখা। আপাতভাবে শুনে এটাকে বৃত্তাকার যুক্তিক্রম বলে মনে হলেও, এটা কিন্তু ভীষণভাবেই সত্যি। কোনো স্টার্ট আপে কাজ করে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু নিজের উদ্যোগে একটা সংস্থা গড়ে তোলাটা সম্পূর্ন আলাদা একটা ব্যাপার।
১)বিশ্বাস করুন, আমি কথাগুলো জেনেই বলছি।আমি নিজে আমার কম্পানি শুরু করেছিলাম দীর্ঘদিন ধরে একাধিক কম্পানিকে বাজারে পরিচিত করে তোলা, নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ করা বা নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গড়ে তোলার মত একাধিক কাযে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত থাকার পর। আমি জানি কিভাবে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। যদিও বাস্তবে আমাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়নি।
২)ভালো স্টার্ট আপ উদ্যোক্তা হতে হলে আপনাকে একেবারে স্টার্ট আপ দিয়েই চলা শুরু করতে হবে।
২)মূলধন – স্টার্ট আপ শুরু করার জন্য প্রচুর টাকা লাগেনা। যেমনটা আমি তিরিশ নম্বর স্লাইডশেয়ারে দেখিয়েছি যে, আজকের দিনে একটা কম্পানি শুরু করার জন্য খুব বেশি খরচ করতে হয়না। যখনই দেখবেন যে ক্রেতারা আপনার পণ্যের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, তখন বরং বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিন(বা মূলধন বাড়ান)।
১)তাছাড়া, আজকে আপনার হাতের কাছে কিকস্টার্টারের মত উপযোগী জিনিস রয়েছে, যার সাহায্যে কাজ শুরু করে সময় ও মূলধন নষ্ট করার আগেই আগাম দেখে নিতে পারেন যে আপনার পরিকল্পনা বাস্তবিকই সফল হবার যোগ্য কিনা।
২)পরিকল্পনা – এটাই হল সবথেকে কঠিন পর্যায়। কারণ সঠিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছাড়া সংস্থার উদ্যোগ কখনোই সফল হবেনা। তাই সঠিক পরিকল্পনা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন আগে সেটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন, এবং তারপর সেটার সমাধান করার উদ্যোগ নিন। এভাবে এগোলে দ্রুত চটজলদি হোক বা দেরি করেই হোক, সাফল্য আপনি পাবেনই। ঠিক যেমনটা হয়েছিল টুইটার বা হটমেলের ক্ষেত্রে।
অতয়েব দেখা যাচ্ছে যে সময় নিয়ে পরে শুরু করার মধ্যে দিয়ে আপনি কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন না। বরং এখন যেহেতু আপনার বয়েস কম রয়েছে এবং ঝুঁকি নেবার মত পরিস্থিতি ও সাহস রয়েছে, তাই এখন শুরু করাটাই শ্রেয়। তাহলে আর অপেক্ষা কিসের?
এখানেই আমি এই লেখায় স্থায়ী ছেদ টনতাম। কিন্তু এই উত্তরটা আমার কাছে ঠিক সন্তোষজনক হলনা। কারণ, একজন জ্ঞানী মানুষ একবার বলেছিলেন – ‘There are good reasons, and there’s a real reason’। অভিজ্ঞতা, মূলধন, পরিকল্পনার অভাব – এই সবকটাই কারণ হিসাবে ভালো(কিন্তু ভ্রান্ত)। তাহলে, এখন প্রশ্ন হল ‘প্রকৃত’ কারণ কোনটা? সত্যিই যদি মূলধনের অভাব থাকে, তাহলে? যদি উপরে বলা কথাগুলো স্রেফ অজুহাত হয়?
বিশেষত, যদি আপনি সত্যিই নিজস্ব কোনো ব্যবসা গড়ে তুলতে চান, এবং আপনার মনে হচ্ছে যে কিছুদিন অন্য কোথাও কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে নিয়ে তারপর নিজের ব্যবসা শুরু করার উদ্যোগ নিতে আপনি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন, তাহলে?
বন্ধু, আপনার ভাগ্য ভালো। কারণ এই প্রশ্নটা আদতে ধোপে টেকেনা। কারণ আপনাকে চাকরি বা স্টার্ট আপ – এই দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে বাছতে হবে, এমনটা একেবারেই নয়। বরং আপনি দুটোই একসাথে করতে পারেন!
দৈনন্দিন চাকরির পাশাপাশি অবসর সময় মতো আপনার পরিকল্পনার বাস্তবতা যাচাই করে নিন(বা চাইলে আপনি MVP করতে পারেন)। ধীরে ধীরে পরিকল্পনাকে বাস্তব রুপ দিন এবং প্রতিটা ক্ষেত্রে ক্রেতাদের ফিডব্যাকের দিকে নজর রাখুন। যদি ব্যররতার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে আপনি নিজেই সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন।
(এটি একটি অনুবাদ। এই রচনার মূল লেখক জিথামিত্রা তথাচারী, মুম্বইয়ে একটি স্টার্টআপ উদ্যোগের কর্ণধার। জিথা পড়তে ভালোবাসেন আর লিখতেও ভালোবাসেন খুব।)