৬০ বছরের পুরনো বনগাঁর চাঁদার হাট যেন মিনি ভারত
বনগাঁ-বাগদা সড়কের পাশে প্রায় ছয় বিঘা জমি। বিস্তীর্ণ এই এলাকা জুড়ে ৬০ বছরের পুরনো চাঁদার হাট। হাটবারে শুধু মাথা দেখা যায়। পিলপিল করে লোকের আনাগোনা। হাঁক-ডাক, চিল-চিৎকার, গাড়ির হর্ন, ইঞ্জিনের আওয়াজে টেকা দায়। রাজ্য তো বটেই ভিন রাজ্যের হাজারো মানুষের ভিড়। চাঁদার হাট যেন সেদিন আক্ষরিক অর্থে মিনি ভারত।
শুরুটা হয়েছিল প্রায় ষাট বছর আগে ১৯৫৭ সালে। দিনে দিনে রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বনগাঁর চাঁদার হাটের সুনাম ছড়িয়েছে ভিন্ রাজ্যেও। এই হাট থেকে সব্জি চলে যাচ্ছে মুম্বই, দিল্লি, উড়িষ্যা, বিহার-সহ দেশের নানা প্রান্তে। একটা সময় ছিল গরুর গাড়ি বোঝাই করে চাষিরা হাটে সব্জি-সহ নানা মালপত্র নিয়ে আসতেন। যারা গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারতেন না, তারা হেঁটে মাথায় করে মালপত্র নিয়ে আসতেন। এখন অবশ্য চাষিরা খেত থেকে ম্যাটাডর ভ্যান বা লরিতে করে সব্জি নিয়ে আসছেন। আশেপাশের এলাকা সভাইপুর, পানচিতা, নকফুল, মাধবপুর, গাঁড়াপোতা থেকে চাষিরা দলে দলে মালপত্র নিয়ে আসেন। হাটের একপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে বেদিয়াপোতা রোড। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে সবজি বোঝাই গাড়ি। হাজারেরও বেশি চাষি এখানে আসেন ফসল বিক্রি করতে। বাঁশের খুঁটি ও টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট ঘরে পাঁচশোরও বেশি দোকান। প্রতি সপ্তাহের বুধ ও শনিবার হাট বসে। ভোর সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ১২টা মূলত পাইকারি হাট বসে। দুপুরের পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলে খুচরো কেনাবেচা।
হাটটির মালিক সুরেশ বিশ্বাস, বিপ্লব বিশ্বাসেরা জানান, ‘অতীতে নকফুল এলাকায় হাট বসত। ১৯৫৭ সালে সেই হাট চাঁদা এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এলাকারই বাসিন্দা অটলচন্দ্র বিশ্বাস ও মহেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এই হাটের সূচনা করেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি লাইসেন্স আছে। বাণিজ্য কর দেওয়া হয় নিয়মিত। হাটের পরিকাঠামো তৈরি করেছেন ব্যবসায়ীরাই’।
বছর ষাটের বৃদ্ধ সুধীন রায় প্রায় ৪০ বছর ধরে হাটে গুড় বিক্রি করছেন। বাড়ি গোবরাপুর গ্রামে। জানালেন, ‘সপ্তাহে দু’দিনের জন্য হাট মালিককে দিতে হয় পাঁচ টাকা। বড় দোকান হলে দিতে হয় ১০ টাকা। বনগাঁ থেকে গুড় এনে বিক্রি করি। এখানে সব কিছুর ব্যবস্থা আছে।’ চল্লিশ বছর ধরে হাটে কাস্তে, দা, হাতুড়ি বিক্রি করছেন পঁয়ষট্টি বছরের মৃণাল কর্মকার। বাড়ি ধর্মপুকুরিয়া গ্রামে। বলেন, বাড়িতেই জিনিস তৈরি করে সাইকেলে করে হাটে এনে বিক্রি করি। হাটের অতীত-বর্তমান সবই দেখা। অতীতে লম্ফ, কুপি ও হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে বেচা-কেনা করতে হত। সন্ধের পরেই বাড়ি । এখন বিদ্যুতের আলো হয়েছে। তাই রাত পর্যন্ত থাকি।’
হাটের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে স্থানীয় মানুষের জীবিকার সম্ভাবনাও। খেত থেকে চাষির ফসল ভ্যানে করে হাটে আনা-নেওয়ার কাজকেই জীবিকা করে নিয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন ভবানী মণ্ডল জানান, ‘ইঞ্জিন ভ্যানে যাত্রীরা বেশি ওঠেন না। প্রতি হাটে ফসল আনা নেওয়া করে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছি। সংসার ভালভাবেই চলে যাচ্ছে। আমাদের কাছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ওই হাট’।
শুধু কী লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ভীন গ্রামের, ভীন রাজ্যের মানুষ আসেন এখানে। আলাপ, পরিচয় থেকে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক, গড়ে ওঠে আত্মীয়তা। লক্ষ্মীর হাত ধরে চাঁদার হাট তখন যেন মিলনমেলা। এক রাজ্যের ব্যবসার সঙ্গে অন্য রাজ্যের ব্যবসার সেতু বন্ধন তৈরি হয়। খুলে যায় আরও কত কারবারের নয়া নয়া দিক।