মুনাফা নয়, ক্লাউডফ্যাকট্রি চায় মানুষ গড়তে
ব্যবসাটা নিছকই আউটসোর্সিংয়ের। কাজ কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি, প্রসেসিং, কালেকশন এবং ক্যাটেগরাইজেশন। নেপালেই জন্ম। সেখানেই যাবতীয় কর্মকাণ্ড। কয়েকজন স্বঘোষিত গুরু নেপালে হাজির হন মানব সম্পদের খোঁজে। কাজটা অনেকটা কয়লা খনিতে হিরে খোঁজার মত। তারপর আকরিক অবস্থায় পাওয়া হিরেকে পালিশ করে ঝলমলে করে তোলা। এই পালিশ করে হিরে বা দক্ষ কর্মী তৈরি করে তাদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় ক্লাউডফ্যাকট্রির পথ চলা।
সূদুর নেপালে চালু হওয়া এই সংস্থার অনুপ্রেরণা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাওয়া। বাংলাদেশের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুস। তাঁর ভাবনায় তৈরি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও মাইক্রোফিনান্সের প্রচলন সেদেশের অর্থনীতির অভিমুখই বদলে দিয়েছিল। সামাজিক সহায়তার ভাবনা ঋণ ফেরত দেওয়াকে নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছিল। ক্লাউডফ্যাকট্রি ঠিক এই মডেলটাই অনুসরণ করে শুরু করেছিল তার আউটসোর্সিংয়ের ব্যবসা।
নেপালে বসবাসকারী তরুণ প্রতিভাদের খুঁজে তাদের কম্পিউটারের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে ক্লাউডফ্যাকট্রি। কম্পিউটারের ছোট ছোট কাজও দক্ষতার ভিত্তিতে আলাদা করে শেখানো শুরু করে তারা। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলে শিক্ষানবিশরা। নাটকীয়ভাবে রপ্ত করে নেয় তাদের করণীয় কাজটা। এবার তাদের ভাল অঙ্কের মাইনেতে নিজেদের সংস্থাতেই চাকরি দিতে শুরু করে ক্লাউডফ্যাকট্রি। এতে সংস্থার আউটসোর্সিংয়ের কাজও উঠল, আবার এসব তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ভবিষ্যত গড়ার পথও খুঁজে পেল।
ক্রমেই ক্লাউডফ্যাকট্রির এই পদ্ধতি একটি ফলপ্রসূ বিজনেস মডেলে পরিণত হয়। যাদের ইউএসপিই হল কম খরচে উন্নতমানের কাজ। যার হাত ধরে ক্রমেই এই সংস্থার একটা সামাজিক প্রতিফলন হতে শুরু করে। আর ক্লাউড প্রযুক্তি যাবতীয় কাজ পরিবহণ ব্যয়ে মোটা টাকা খরচের ঝামেলা রইল না।
কিছুদিনের মধ্যেই ক্লাউডফ্যাকট্রি এলাকাভিত্তিক দল তৈরি করে কাজ করতে শুরু করল। একই এলাকায় বসবাসকারী কয়েকজনকে নিয়ে এই দল তৈরি করে দিল তারা। এদের আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক সপ্তাহ করে মূল্যায়ন করতে লাগল সংস্থা। দলগত ও ব্যক্তিগত, দুইভাবেই রেটিং পেতে শুরু করলেন প্রত্যেক সদস্য। এদের মধ্যে রেটিংয়ের নিরিখে যে অন্যদের চেয়ে দুর্বল প্রতিপন্ন হল তাকে দল থেকে সরিয়ে দিল ক্লাউডফ্যাকট্রি। এতে দলগুলির উৎপাদন দক্ষতা আরও বাড়তে লাগল। যদিও এখানেই মূল্যায়ন শেষ নয়, দলের প্রত্যেক সদস্যের চরিত্রের রেটিং দেওয়ার পদ্ধিতও চালু করল সংস্থা। কীভাবে মাপা হবে এই চরিত্রের রেটিং? ক্লাউডফ্যাকট্রি ঠিক করল প্রতিটি দলের এক একজন সদস্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজের উৎপাদন ক্ষমতার লক্ষ্য স্থির করবে। তারপর সেই লক্ষ্য ছোঁয়ার পিছনে ছুটবে। এর সাফল্যের ওপরই নির্ভর করবে তাঁর চরিত্রগত রেটিং। ক্লাউডফ্যাকট্রির সেলস ও মার্কেটিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট টম পুসকারিচের দাবি, তাঁদের সংস্থা শুধু চাকরি তৈরি করে না, সেইসঙ্গে একজন নেতারও জন্ম দেয়। যারা দারিদ্রকে মুছে দিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সংস্থায় একটা ভাল অঙ্কের লগ্নি ক্লাউডফ্যাকট্রিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। টমের মতে, এই লগ্নিকারীরা একাধারে যেমন সংস্থার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে উৎফুল্ল, তেমনই উৎফুল্ল তাদের লাভজনক দিক নিয়েও। এই মুহুর্তে ১৫০ জন কর্মী নিয়ে কাজ করছে ক্লাউডফ্যাকট্রি। হালেই এক সপ্তাহের মধ্যে ১ লক্ষ ১৮ হাজার কাজ শেষ করে রেকর্ড গড়েছে তারা। আর এই সংখ্যা আগামী দিনে আরও কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব বলেই বিশ্বাস টমের।
ক্লাউডফ্যাকট্রির মুনাফামুখী মডেলই কিন্তু সংস্থার প্রতিপত্তির ব্যাপ্তিকে এতটা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। কারণ মুনাফার জন্য দরকার টিকে থাকা, আর সেই টিকে থাকাই তাদের এমন সূদুরপ্রসারী ফল উপহার দিয়েছে। তবে টমের মতে, সংস্থার লক্ষ্য মুনাফার পাহাড় তৈরি করা নয়, বরং সেইসব নেতৃত্ব বা পেশগত প্রতিভাকে খুঁজে বার করা, যারা কেবলমাত্র আর্থিক দুর্বলতার কারণে অচীরেই কোথায় হারিয়ে যায়। টম জানেন, এসব প্রতিভারা কেউই বেশিদিন ক্লাউডফ্যাকট্রির সঙ্গে কাজ করবে না। বরং এঁদের মধ্যেই কেউ সাংবাদিক হবে, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার হবে আবার কেউবা অন্য কোনও পেশায় নিজেকে মেলে ধরবে। কিন্তু এঁদের তৈরি করায় চিরদিন ক্লাউডফ্যাকট্রির একটা বড় ভূমিকা থেকে যাবে। কারণ ক্লাউডফ্যাকট্রি কেবল একজন দক্ষ কর্মীর জন্ম দেয় না, একজন নেতারও জন্ম দেয়।