বাঙলার সাজ সমুদ্রে নতুন 'তরঙ্গ'
কলকাতা থেকে বোলপুরে উইকেন্ডে ছুটি কাটাতে গেছেন আর খোয়াইয়ে সোনাঝুড়িতে হাটে যাননি এমন মানুষ বিরল। আর যদি গিয়ে থাকেন তাহলে সোনাঝুড়ি গাছেদের নরম ছায়ায় পসরা সাজিয়ে বসা অসংখ্য বিক্রেতার ভিড়ে বাঙলার নকশাদার কাঁথা, কাঁথাস্টিচের শাড়ি ও বাংলা গ্রাফিক টিশার্টের সম্ভার নিয়ে বছর ৩২ এর এই সুশ্রী যুবকটিও নিশ্চয়ই আপনার নজর এড়িয়ে যায়নি। হারিয়ে যেতে বসা বাঙলার চিরায়ত কাঁথাশিল্পকে যিনি সনাতন বাঙালীয়ানা ও আধুনিকতার সুচারু মেলবন্ধনে দিতে চাইছেন এক নবজন্ম।
দীপক সংরাগ। জন্ম বাঁকুড়া জেলার মঙ্গলপুরের বেতালন গ্রাম। সেখান থেকে প্রাথমিক পড়াশোনা সমাপ্ত করে চলে আসেন বোলপুরের শান্তিনিকেতনে, ভর্তি হন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পসদনে। সেখান থেকে টেক্সটাইল নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরীর সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে ক্ষয়ে যাচ্ছিল জুতোর সুকতলা। কিন্তু দমবার পাত্র নন তিনি। তাই প্রথাগত চাকরীর চক্কর ছেড়ে বেড়িয়ে এসে নেমে পড়লেন টেক্সটাইলের ব্যবসায়। পুঁজি মাত্র ৮ হাজার টাকা। জন্ম হল ‘তরঙ্গ শান্তিনিকেতন’ বুটীকের। সালটা ২০১২। “প্রথমে দোকান নেওয়ার টাকা ছিলনা। একটা টেবিল বানালাম, সেই টেবিল বানাতেই আট হাজার টাকা চলে গেল। তারপর আমার দিদির থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে কিছু টিশার্ট প্রিন্টিং করে সেই টেবিলে বসে বিক্রি শুরু করলাম”। এভাবেই তরঙ্গ বুটিকের যাত্রা শুরু। এরপর ক্রমে টিশার্ট থেকে কুর্তা, পাঞ্জাবী হয়ে শাড়ি প্রিন্টিং ও পরবর্তীকালে বাঙলার ঐতিহ্যশালী কাঁথা শিল্পে হাত দিলেন দীপক। তৈরি হল পাকা আস্তানা, শোরুম, ওয়ার্কশপ।
কাঁচা মাল কিনে আনা থেকে কাপড় সংগ্রহ, নিজস্ব নিত্য নতুন ডিজাইনের ভাবনা চিন্তা থেকে জৈবিক পদ্ধতিতে নিজে হাতে রঙ তৈরি ও সর্বোপরি সেই সব ডিজাইন প্রিন্ট করে সেগুলিকে বিক্রি -এই সমগ্র কর্মযজ্ঞ দীর্ঘদিন একা ঘাড়ে করে বয়ে এসেছেন দীপক। আর এই দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে অবশেষে এখন দেখছেন কিছুটা সাফল্যের মুখ। বর্তমানে তাঁর ওয়ার্কশপে প্রায় আট দশ জন স্থানীয় শিল্পী কাপড় প্রিন্টিং এর কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। যদিও কাঁচা মাল কিনে আনা থেকে ডিজাইন ও বিক্রির পুরো ভারটাই এখনও দীপক একাই বহন করেন। মাঝেমাঝে শাড়ি ও কাঁথার ডিজাইনে সাহায্য করেন তাঁর দিদি। আর এভাবেই পাঁচ বছর কঠিন লড়াইয়ের পর আজ শান্তিনিকেতনে তরঙ্গ হয়ে উঠেছে অতি পরিচিত একটি নাম। তবে কেবল শান্তিনিকেতন নয়, বোলপুরের লালমাটির রুক্ষ পথ থেকে তরঙ্গ’র কাঁথা ও শাড়ি স্থান করে নিয়েছে কলকাতার আলো ঝলমলে শপিং মলেও। আর কলকাতা থেকেই দীপক দেখতে পাচ্ছেন সুদূর স্বপ্নের হাতছানি, তরঙ্গ বুটিকের কাঁথা ও শাড়ির সম্ভার যাত্রা করতে চলেছে ইউরোপের বাজারে।
তবে কলকাতার কোলাহলের বাইরে খোয়াইয়ের লালমাটির ছায়ানির্জন শনিবারের হাটই দীপকের বেশী প্রিয়। এখানেই প্রতি শনিবার তিনি নিত্য নতুন পণ্যের সম্ভার সাজিয়ে বসে পড়েন। বিকিকিনিও মন্দ হয়না ইদানীং। তবে শান্তিনিকেতনেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও তরঙ্গ বুটিকের মূল ক্রেতা পরিমণ্ডল মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক, বোলপুরের অধিকাংশ হস্তশিল্প ও বুটিকের ক্ষেত্রেই যা সত্যি। কিন্তু দীপক এই ছকটিকেও ভেঙে দিয়েছেন তার এক অভিনব প্রয়াসের মাধ্যমে। তিনি নিয়ে এসেছেন বাংলা গ্রাফিক টিশার্ট। জীবনানন্দ থেকে জয় গোঁসাই, সহজপাঠ থেকে লালন সাঁই, সকলেই একে একে স্থান করে নিয়েছেন তরঙ্গের বাংলা গ্রাফিক টিশার্টগুলিতে। আর এই অভিনবত্বকে বক্ষে ধারণ করার জন্য বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতনের যুবসমাজ হানা দিচ্ছেন শহরের ভিড় থেকে দূরে খোয়াইয়ের বনছায়ায় তরঙ্গের ছিমছাম দোকানঘরটিতে।
সব মিলিয়ে বাঙলার টেক্সটাইলের অগাধ শিল্প-সমুদ্রে এক নতুন তরঙ্গ তোলবার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছেন বাঁকুড়ার দীপক সংরাগ। অপেক্ষা শুধু আপনার পদার্পণের।
ফেসবুক পেজ - তরঙ্গ শান্তিনিকেতন